‘কৃষি’ কেন গুরুত্বপূর্ণ

বারসিক এর সাথে আমার যাত্রা ২০১১ সাল থেকে। প্রথম বার ফেলোশিপ এর মাধ্যমে দ্বিতীয়বার গবেষণা সহকারী হিসেবে ২০১২ সালে এবং সব শেষে ২০১৪ সালে কর্মী হিসেবে। প্রতিবার যখনই জানার চেষ্টা করেছি বারসিক কী নিয়ে কাজ করে। তখন বারবারই সবকিছু ছাঁপিয়ে প্রধান কাজ হিসেবে দেখা দেয় ‘কৃষি’ র নাম। আবার আমি নিজেও যখন অন্য কাউকে বোঝাতে যাই তখন বোঝানোর শেষে সেই ব্যক্তি বলে ওঠেন, ‘‘ও আপনারা কৃষি নিয়ে কাজ করেন”। কিংবা কখনো বোঝানোর কষ্ট না করে বলি কৃষি নিয়ে কাজ করি। কিন্তু, বারবারই মনে হয়েছে, শুধু কৃষি দিয়ে বারসিক কে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিনিধিত্ব করা হয় কি? এই প্রশ্নের উত্তর অনেক দিন খুঁজেছি। তবে মন ভরেনি। অবশেষে, গত বছর বারসিক রামেশ্বরপুর রিসোর্স সেন্টার এ আমি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যায়ল এর নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক অভিজিৎ রায় এবং বারসিক এর সমন্বয়কারী সৈয়দ আলী বিশ্বাস এর সাথে একটি আড্ডার আলোচনা থেকে এর আংশিক উত্তর খুজে পাই। সেদিনকার সেই বোঝাপড়া আমি বারসিক পরিবার এবং শুভাকাংখিদের সাথে শেয়ার করতে আগ্রহ প্রকাশ করছি।
বারসিক ২০০১ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রধানত যে কাজটা করে সেটা হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদকে মানুষ কীভাবে জীবনধারনের জন্য চর্চার মধ্য দিয়ে সেটাকে (প্রাকৃতিক সম্পদ) সংরক্ষণ করে। বারসিক তার এই ধারণাগত জায়গাকে স্পষ্ট করার জন্য- মানুষকে বোঝার জন্য যে, মানুষ কীভাবে প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে তার জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করছে। এই ৩ বছর মানুষের সেই সমস্ত কৌশল বোঝার চেষ্টা ও ডকুমেন্টেশন করেছে।
এই ৩ বছরের কাজের মধ্য দিয়ে প্রধানত ৩টি বিষয়কে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। যথা:
১)     প্রাকৃতিক সম্পদ,
২)     চর্চা ও ব্যবহার এবং
৩)     সংরক্ষণ।
এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে পারষ্পারিক সম্পর্ক হচ্ছে কৃষি। আর কৃষির সাথে এই সম্পর্ক হচ্ছে জ্ঞান উৎপাদনের সর্ম্পক।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই কৃষি বা কৃষকের জ্ঞান বা সাধারণ জনগণের জ্ঞান কেন বারসিক এর কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ? কেননা আধুনিক জ্ঞান যেখানে কৃষি পন্যের উৎপাদনকে বৃদ্ধি করে। পাশাপাশি যে কোন সমস্যা সমাধানে আধুনিক জ্ঞান অনেক বেশি কার্যপোযোগি; সেখানে কেন বারসিক এত বেশি সাধারণ মানুষের জ্ঞানকে প্রাধান্য দিচ্ছে?
আমরা সবসময় পড়ে এসেছি, শিখে এসেছি এবং জেনে এসেছি যে, কৃষি হচ্ছে উৎপাদন (প্রোডাকশন) এর বিষয়, বাণিজ্যিক (মার্কেট) বিষয়, কৃষি হচ্ছে লাভ-ক্ষতির বিষয়। পাশপাশি কৃষিকে সমসাময়িক সময়ে সাধারণীকরণ করা হয় খাদ্য নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে।
কিন্তু বারসিক যখন কৃষকের কাছ থেকে ‘কৃষিকে’ বুঝার চেষ্টা করে তখন দেখা যায় কৃষকের কাছে কৃষি শুধুমাত্র উৎপাদনের বিষয় নয়। এটি একজন কৃষকের কাছে সমগ্র জীবনের বিষয়। কৃষি হচ্ছে সামাজিক বন্ধনের ও সামাজিক সংহতির বিষয়। গ্রামীণ জীবনের পারস্পারিক দ্বন্দ্ব সংঘাত ও সংহতির বিষয়। কেননা কৃষির মধ্যে দিয়েই একটি গ্রামের সম্পর্ক তৈরি হয় এবং বিরাজ করে। একই সাথে কৃষি হচ্ছে পরিবেশ এবং প্রতিবেশীয় বিষয়। এটি কৃষকের কাছে মাটি ও বাস্তুসংস্থান এর বিষয়। একইসাথে এটি কৃষকের কাছে বৈচিত্র্যের বিষয়। বৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখার বিষয়, বৈচিত্র্যের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার বিষয়।
কিন্তু কৃষি যখন একজন উন্নয়ন কর্মী/প্রতিনিধি (এজেন্ট) বা একজন গবেষক যখন উপস্থাপন করে তখন সে নিয়ে আসে লাভ-ক্ষতি, কৃষি উপকরণ এবং খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়গুলো। আর সকল উন্নয়ন এজেন্সী কৃষিকে একইভাবে উপস্থাপন করে। কিন্তু একজন কৃষকের কাছে কৃষির বিষয়টি তার জীবনাদর্শনের সাথে সম্পর্কীত। কৃষক তার কৃষিকে কক্ষনোই ওতোটা সরলীকরণ করে দেখে না। একজন কৃষক যখন তার কৃষিকে তার প্রতিবেশ, তার গ্রাম, তার বৈচিত্র্যময় জীবনযাপনের সাথে আন্তঃসম্পর্ক করে ভাবতে পারে; তখন কোনভাবেই এই কৃষি এবং কৃষকের জ্ঞান উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে না রাখার অবকাশ থাকে না। সুতরাং গ্রামে কাজ করার ক্ষেত্রে এই একটি কারণই যথেষ্ট কৃষি এবং কৃষকের জ্ঞানকে গুরুত্ব দেয়ার।
তাই বারসিক যখন বৈচিত্র্য নিয়ে কথা বলে তখন এটি আসলে চলে আসে কৃষকের দৃষ্টিতে দেখা বৈচিত্র্যকে। আর কৃষি হচ্ছে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের টিকে থাকার, বেঁচে থাকার জ্ঞান এবং কৌশল। তাই গ্রামের মানুষের সাথে সর্ম্পক স্থাপনের একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে কৃষিকেন্দ্রিক কৃষকের চিন্তা দর্শনকে প্রাধান্য দিয়ে সামাজিক সম্পর্ক, পরিবেশ, সমাজনীতি, অর্থনীতি তথা সমাজ কাঠামোকে বোঝা।
বীজ হচ্ছে কৃষির প্রথম এবং প্রধানতম হাতিয়ার। বীজকে কেন্দ্র করেই কৃষির যতধরনের সমস্যার সূচনা; কৃষির ব্যবসায়িক এবং রাজনৈতিক যাত্রা। বীজ যখন কৃষকের হাত থেকে বাজারের হাতে চলে গেছে তখন বীজ এবং কৃষির সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়গুলো নষ্ট হয়ে যায়। একটি গ্রামের মধ্যে যে সামাজিক সংহতি আছে সেগুলো ভেঙে পড়ে। সংহতির সাথে সাথে মানুষে মানুষে যে ইউনিটি আর থাকে না। কেননা কৃষি ও কৃষকের সম্পর্ক বিনিময়ের সম্পর্ক যা বাজার থেকে আসে না। যদি আসে তবে সেটা পারস্পারিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক নয়, নৈর্ব্যত্তিকভাবে ক্রেতা-ভোক্তার সম্পর্ক। পারস্পারিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক তৈরি হয় পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মান প্রকাশের ভেতর দিয়ে।
এই নির্ভরশীলতার সম্পর্ক শুধু মানুষে মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই নির্ভরশীলতা প্রাকৃতিক উপদানের মধ্যে রয়েছে। রয়েছে পেশার বৈচিত্র্যতার মধ্যেও। যদি কৃষি ভালো না থাকে তাহলে মাছ থাকবে না। আর মাছ যদি না থাকে বাঁশ-বেত শিল্প থাকবে না। এই বাঁশ-বেঁত শিল্প যে সমস্ত উপকরণ বানায় সেগুলো বেশিরভাগই লাগে মাছ ধরা এবং কৃষি ক্ষেত্রে। কৃষির মতো মৎস্যও যদি বাণিজ্যিক হয়ে যায় তাহলে বাঁশ-বেঁত শিল্পও হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে কুমার। কারণ কৃষির সাথে মাটির যে সম্পর্ক; বীজের সাথে মাটির যে সম্পর্ক সেটি হারিয়ে গেলে মাটির গুনগত মান নষ্ট হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে কাজের ক্ষেত্র তৈরি না হওয়া। যেহেতু এখানে জনসংখ্যা বেশি সেহেতু এখানে কাজের চাহিদাও বেশি। আর কাজের সংকট তৈরি করতে হবে রাখতে হবে মুক্তবাজার অর্থনীতির ব্যবসায়িক স্বার্থে। প্রতিদিন কৃষি, মৎস্য, বাঁশ-বেঁত শিল্পের মতো অসংখ্য কাজের ক্ষেত্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে মানুষগুলো কী করবে বা তাদের কী ধরনের কাজ সরবরাহ করা হবে। কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে একটার সাথে আর একটার আন্তঃসম্পর্কের মধ্য দিয়ে। আর যখন এই আন্তঃসম্পর্ক থাকছে না তখন তৈরি হচ্ছে সমস্যা। আমরা তখন হয়ে যাচ্ছি ব্যবসায়ী। আর তখনই বাজার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ অর্ন্তভূক্ত থাকে প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। কিংবা এভাবে বলা যায় সকল জ্ঞানের উৎপত্তি এই প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে। কিন্তু যখন এই প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর না থেকে সবাই বাজারনির্ভর ব্যবসায়ী হয়ে যাচ্ছি তখন আর নতুন জ্ঞান উৎপাদন হচ্ছে না। আর এই জ্ঞান যখন একটা কমিউনিটি থেকে উৎপাদন হচ্ছে না তখন এই জায়গাটা দখল করছে বাইরে থেকে আগত মানুষ, প্রযুক্তি এবং কোম্পানি।
এর ফলে কৃষক, জেলে এবং বাঁশ-বেত শিল্পীর মধ্যকার যে আন্তঃসম্পর্ক সেটি না থাকলে কোনভাবেই কেউ টিকবে না। শুধু মাছ বাঁচিয়ে জেলেকে রক্ষা করা যাবে না; যদি না ভিন্ন ভিন্ন মাছ না থাকে তাহলে সেই ভিন্ন ভিন্ন মাছ ধরার জন্য ভিন্ন ভিন্ন উপকরণ থাকবে না। ভিন্ন ভিন্ন উপকরণ থাকবে না; যদি না কৃষকের বাঁশ-বেঁত এর জন্য আলাদা জায়গা না থাকে। এই আন্তঃসম্পর্ক ঘুরে ফিরে বারবার আসে শেষ হয় কৃষিতে। তাই সবার আগে এই দেশের নিজস্ব কৃষি ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হবে।
এই ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হলে এই প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যকার যে আন্তঃসম্পর্ক, আন্তঃনির্ভরশীলতা এবং আন্তঃবিনিময়কে বজায় রাখতে হবে। তাই কৃষিকে রক্ষা করতে হলে শুধু কৃষি বা কৃষক দিয়ে হবে না। কৃষি বা কৃষকের সাথে সাথে জেলেকে রক্ষা করতে হবে। জেলেকে দিয়ে জেলে রক্ষা হবে না যদি কোন মাছ ধরার জন্য কি ধরনের জিনিস দরকার- তা না থাকে। তাই এই ব্যবস্থার জন্য প্রতিটি জায়গাকে শক্তিশালী করতে হবে। একই সাথে এদের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক এবং আন্তঃনির্ভরশীলতাকে শক্তিশালী করতে হবে। তখনই বারসিক এর বিভিন্ন পেশাভিত্তিক সংগঠনগুলো সামনে চলে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষক সংগঠন, জেলে সংগঠন, বাঁশ-বেঁত সংগঠন, মাটিকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীর সংগঠনসহ অন্যান্য সংগঠন গড়ে উঠেছে।
বারসিক শুরু করেছিল শুধু কৃষি দিয়ে। কিন্তু বর্তমানে কৃষি কিন্তু শুধু কৃষি থাকেনি। বীজ কিন্তু শুধু বীজ থাকেনি। এটি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল যে কোন একটি গ্রামের সমগ্র বিষয়ই অর্ন্তভুক্ত হয়েছে। তাই বারসিক এর কাছে কৃষি কক্ষনোই শুধুমাত্র উৎপাদনের বিষয় না। কৃষি সামাজিক সম্প্রীতির বিষয়। সামাজিক বন্ধনের বিষয়। কৃষি হচ্ছে পরিবেশ এবং প্রতিবেশের বিষয়। কৃষি হচ্ছে প্রাণ বৈচিত্র্যের বিষয়।
তাই বারসিক কৃষিকে কেন্দ্র করে একটি গ্রামের সকল বিষয় নিয়ে কাজ করে থাকে। কৃষি কেন্দ্রিক অন্যান্য কার্যক্রমগুলো শুধুমাত্র উৎপাদনকে নয়; মানুষে মানুষে আন্তঃসম্পর্ক, আন্তঃনির্ভরশীলতাকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

Recommended Posts