তবুও সাধারণীকরণ করার জন্য ক্ষুদ্র খামারের একটা নির্দিষ্ট আয়তন নির্ধারণ করতে হবে। নিচের তথ্য থেকে বুঝতে সুবধিা হবে ক্ষুদ্র খামারের আয়তন কতটুকু হয়। তার আগে বলে রাখা ভালো যে, পৃথিবীর অর্থনৈতিক কাঠামো অনুযায়ী সমগ্র পৃথিবীকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা:
১) উন্নত বিশ্ব বা উত্তরাংশ: যা পৃথিবীর ধনী দেশগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব কম। শিল্প, প্রযুক্তি, অবকাঠামোসহ অন্যান্য দিক দিয়ে এগিয়ে।
২) অনুন্নত বিশ্ব বা দক্ষিনাংশ: যা মূলত পৃথিবীর গরীব (!), দূর্ভিক্ষ (!), দূর্যোগ (!) পীড়িত দেশগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি এখনো টিকে আছে। এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব উত্তরাংশের চেয়ে অনেক অনেকগুণ বেশি। আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং এশিয়া মহাদেশের অধিকাংশ দেশই এই অংশের অর্ন্তভূক্ত। এই অংশকে কখনো তৃতীয় বিশ্বও বলা হয়ে থাকে।
(বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে এই বিভাজন কোন ভৌগলিক বিভাজন নয়। বরং অর্থনৈতিক বা মনস্তাত্বিক বিভাজন। তাই পৃথিবীর দক্ষিনাংশের অনেক দেশই উত্তরাংশের প্রতিনিধিত্ব করে।)
ক্ষুদ্র খামার এর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জমির মালিকানা। জমির মালিকানা কার হবে? ক্ষুদ্র খামার বলতে বোঝাচ্ছি যেখানে খামারের শ্রম, জ্ঞান, সময়, খামার ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি যে ব্যক্তি ব্যয় করেন তিনিই ক্ষুদ্র খামারের মালিক (কোন কোন ক্ষেত্রে জমির মালিকানা তার না থাকলেও নিয়ন্ত্রণ তার হাতে থাকে)। পক্ষান্তরে বড় খামারের মালিকের কৃষি কাজের প্রাথমিক বিষয়গুলোর সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকে না বললেই চলে। আরা যারা সেই খামারে কৃষি কাজ করেন তাদেরকে কৃষক না বলে কৃষি শ্রমিক বলাই ভালো। বাংলাদেশ সহ দক্ষিণাংশের অনেক কৃষক আছে যাদের নিজস্ব জমি নেই। যাদেরকে আমরা ভূমিহীন কৃষক বা বর্গাচাষী কৃষক বলি। অন্যদিকে দক্ষিণাংশের অনেক আদিবাসী কৃষক রয়েছে যাদের জমি ব্যক্তি মালিকানায় থাকে না। সেক্ষেত্রে এই সমস্ত কৃষক এর নিয়ন্ত্রণে থাকা খামারগুলোকে কী বলা হবে? হ্যাঁ ভূমিহীন কৃষক, বর্গাচাষী এবং আদিবাসী কৃষকের খামারগুলোও ক্ষুদ্র খামারের অর্ন্তভূক্ত হবে। বর্গা বা লিজকৃত খামার এর ক্ষেত্রে শর্ত থাকে যে জমির মালিককে যেন কৃষক চিনতে পারে এবং তার সাথে যেন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকে। ক্ষুদ্র খামারের জমির মালিকানা কখনোই কোন কোম্পানি বা কর্পোরেশন এর হাতে থাকবে না। কৃষক জমির মালিককে যেন ব্যক্তিগতভাবে চিনতে পারে এবং উভয়ের সাথে একটি ‘প্যাট্রন-ক্লাইন্ট’ সম্পর্ক থাকবে।
ক্ষুদ্র খামারের কৃষক হয় প্রধানত নারী এবং প্রবীণরাই। এরা শখে কিংবা কৃষির প্রতি ভালোবাসার জায়গা থেকে কৃষিকাজ করে থাকে। ক্ষুদ্র খামারের সাথে পরিবারের সকল সদস্যের শ্রমঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় ফসলের এক অভয়ারণ্য হিসেবে বিবেচিত হয় ক্ষুদ্র খামারগুলো। কৃষির সাথে সাথেই প্রাণী সম্পদ (হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল প্রভৃতি) এবং মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা ক্ষুদ্র খামারের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান।
সবশেষে ক্ষুদ্র খামারে কোন ধরনের জিএমও বা একক প্রজাতির শস্য উৎপাদন করে না। পাশাপাশি, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহার করা হয় স্বল্পমাত্রায় বা হয় না বললেই চলে। কোম্পানির বীজ ব্যবহার করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের সংরক্ষণে পরবর্তী মৌসুমের জন্য বীজ থাকে।
ক্ষুদ্র খামারগুলোর প্রাণ-প্রকৃতি আর জ্ঞানে সমৃদ্ধ হলেও সম্পদের (রিসোর্স) দিক দিয়ে একেবারেই তলানিতে। প্রযুক্তির ব্যবহার হয় একবারেই প্রান্তিক পর্যায়ের। বাজার এবং কোম্পানি নির্ভরশীলতা তুলনামুলক কম থাকে।
এই হলো অনুন্নত বা পৃথিবীর দক্ষিণাংশের ক্ষুদ্র খামারের বৈশিষ্ট্য। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য যে খামারের থাকবে না। তা অবশ্যই বড় খামার। আশা করি এই বৈশিষ্ট্যের আলোকে আমরা খুব সহজে চিহ্নিত করতে পারবো কোনটি ক্ষুদ্র আর কোনটি বড় খামার।
এখন আসি শুরুর প্রশ্নে? আমরা কি চাই- ক্ষুদ্র খামার না বৃহৎ খামার? সেটি পাঠকের কাছেই ছুড়ে দিলাম। আমরা দুটি খামারকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেই বিবেচনা করবো কোনটি আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রাণ-প্রকৃতি, প্রজন্ম এবং পৃথিবীর জন্য জরুরি। টেকসই উন্নয়নের জন্য আমরা কোন ধরনের খামার বেছে নেবো। আমিও ভাবতে থাকি। অন্য কোন লেখায় সেটি নিয়ে আলোকপাত করার ইচ্ছা রইল।