পলক মুচ্ছল একজন দেবীর কথা

কাল থেকে পলক মুচ্ছল শব্দটি মাথার ভিতর থেকে যাচ্ছেই না। একটা ঘোরের মধ্যেই
আছি। কিভাবে সম্ভব? বয়স মাত্র ২৪। কিন্তু হাজার বছর বেঁচেছেন এর মধ্যে। কিংবা বলা
যায় হাজার বার জন্ম নিয়েছেন হাজার খানিক জীবন বাঁচিয়ে।
কিশোরী পলক মুচ্ছাল 

৮ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখ পর্যন্ত তিনি গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করে বাঁচিয়েছে ১৩৩৩
টি শিশুকে। যাদের সকলেই হার্ট এর অসুখে ভুগতেছিল। এদের সবাইকে অপারেশন এর মাধ্যমে
সুস্থ্য করা সম্ভব হয়েছে। ভারতের প্রায় সকল শহর সহ পৃথিবীর অনেকগুলো দেশে মঞ্চে গান
পরিবেশন করে অর্থ সংগ্রহ করেছে। সেই অর্থ দিয়ে বাঁচিয়েছে এবং বাঁচাচ্ছে হৃদরোগে
আক্রান্ত শিশুদের। এই বিশেষ অবদানের জন্য ইতোমধ্যেই গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস
এবং লিমকা বিশ্ব রেকর্ড এ তার নাম উঠেছে এই অনবদ্য এবং অনন্য কাজের স্বীকৃতি
স্বরূপ। এছাড়াও ভারতীয় নানা পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছে সে।  
একবার চিন্তা করুন যখন আপনার আমার বয়স মাত্র ১১ বছর। তখন আমরা কি করতাম? নাওয়া
খাওয়া ভুলে গিয়ে খেলতাম আর খেলতাম। আর এই মেয়েটি তখন ১০০ এর বেশি হৃদরোগে আক্রান্ত
বাচ্চাকে অপারেশন এর মাধ্যমে সুস্থ্য করে তুলছে। শুধু তাই নয় অপারেশন এর সময় সে
অপারেশন থিয়েটারের রোগির পাশে থেকে প্রার্থনা করতো। ডাক্তাররা তাকে অপারেশন
থিয়েটারে প্রবেশ করার অনুমতিই দিতেন না- পাশাপাশি ঐ ছোট্ট মেয়েটির জন্য ছোট্ট
অপারেশন অ্যাপ্রোনও রাখতেন। এই কাজের বিনিময়ে সে ঐ পরিবার এর কাছ থেকে ১ টি করে
পুতুল ছাড়া আর কিছুই নিতো না। একবার ভাবুন তো ঐ পরিবার গুলোর কাছে এই ছোট্ট মেয়েটি
কে? দেবী ছাড়া কি! সৃষ্টিকর্তা তাকে পাঠিয়েছেন বুঝি এই কাজের জন্য। তাইতো
শিল্প-সংগীত এর ছোঁয়াও নেই এমন পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেও নিজের কণ্ঠ দিয়ে বাঁচাচ্ছেন
হাজারো দরিদ্র হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুদের। সে একজন কন্ঠ দেবী- স্বরস্বতী!     
নাম তার পলক মুচ্ছল। জন্মেছেন ভারতের মধ্য প্রদেশ এর ইন্দোর শহরে একটি
মাড়োয়ারি পরিবারে। চাকুরীজীবী বাবা আর গৃহিণী মা বাবার মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৯২
সালের ৩০ মার্চ মাসে প্রথম সন্তান হিসেবে জন্ম গ্রহণ করেন পলক মুচ্ছল। একটি ছোট
ভাইও রয়েছে। পরিচয় তার বলিউডের প্লেব্যাক সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে। যদিও তার পরিবারের
কারোর সাথেই সঙ্গীতের কোন যোগাযোগ নেই। মেয়েটির 
বয়স যখন আড়াই বছর- হঠাৎ একদিন পারিবারিক একটি অনুষ্ঠানে সবাই যখন কিছু না
কিছু পরিবেশন করছে।তখন মেয়েটি তার মায়ের কাছে মিনতি করলো কিছু পরিবেশন করবো বলে।
মা ভাবল মেয়েটি কোন ছড়া বা কবিতা বলবে। কিন্তু মঞ্চে উঠে মেয়েটি গান পরিবেশন করলো।
মা তখন থেকেই সিদ্ধান্ত নিলেন তাকে গান শেখাবেন। মেয়েটির বয়স যখন চার বছর তখন সে
আনন্দ-কল্যাণজি লিটল স্টার নামের সংগঠনের সদস্য হলো।
অপারেশনে সুস্থ্য হওয়া একজন শিশুর সাথে হাসপাতালে 

১৯৯৯ সাল মেয়েটির বয়স তখন সাত বছর। তখন ভারতে শুরু হল কারগিল যুদ্ধ। মেয়েটির
মা মেয়েটিকে পত্রিকা থেকে যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং সৈনিকদের দুর্দশার কথা পড়ে শোনাতেন।
মেয়েটির কোমল হৃদয় কেঁদে উঠলো। ভাবল শুধু ঘরে বসে না থেকে তার কিছু করার রয়েছে।
একটি দানের বক্স নিয়ে দোকানে দোকনে গিয়ে বলল, “আমি আপনাদের একটি গান শোনাবো।
বিনিময়ে আপনার যা খুশি কিছু এই বক্সে দান করবেন।’’ মেয়েটি গান গেয়ে গেয়ে সেই সময়ে ২৫
হাজার ভারতীয় মুদ্রা সংগ্রহ করলেন এবং সুনির্দিষ্ট কতৃপক্ষের কাছে সেটি জমা দিলেন।
এই খবরটি স্থানীয় মিডিয়ায় ব্যাপক সাড়া ফেলে। মেয়েটি পায় সামনে চলার এক অনুপ্রেরণা।
একই বছর ভারতের অঙ্গরাজ্য ওড়িশ্যায় সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্থদের সাহায্যের জন্যও গান
গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করে। এগুলো হল মেয়েটির শুরুর গল্প। পাশাপাশি মেয়েটি প্রায় দেখতো
তার বয়সী ছেলে মেয়েরা নিজের পড়নের পোশাক দিয়ে ট্রেনের বগি, গাড়ি প্রভৃতি ধোয়া-মোছা
করে। তখন তার মনে ভাবনার উদয় হয়েছে যে, সে তার কণ্ঠ দিয়ে মানুষের সাহায্য করবে। সে
তার বাবা-মাকে তার এই ইচ্ছার কথা জানালে তারা স্বানন্দে গ্রহণ করে। কাকতলিয়ভাবে
সেই সময়কালে ইন্দোরের একটি স্কুলের একজন শিক্ষক তার স্কুলের লোকেশ নামের একজন
হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসার জন্য পলক এর পরিবারের কাছে সাহায্যের জন্য আসে।
তখন মেয়েটি লোকেশের জন্য একটি ভ্রাম্যমাণ মঞ্চ করে সেখানে গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ শুরু
করে। ২০০০ সালের মার্চ মাসে বেশ অনেক গুলো মঞ্চ পরিবেশনার পর ভারতীয় মুদ্রায় ৫১
হাজার রুপি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। মেয়েটির এই কাজ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত
হলে কারডিওলজিস্ট দেব প্রসাদ শেটি লোকেশের বিনামুল্যে অপারেশন করেন। পলক এবং তার
পরিবার চিন্তায় পড়ে গেল এই টাকা কি করবে? তারা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলেন যে, যদি
কোন শিশু হৃদরোগে আক্রান্ত থাকে তাহলে যেন অতিসত্তর যোগাযোগ করে।  পরের দিন ৩৩ জন শিশুর পরিবার যোগাযোগ করে- যাদের
প্রত্যেকের হৃদরোগের অপারেশন করা লাগবে। পলক এবং তার পরিবার খুবই চিন্তায় পড়ে যান।
এতো শিশু হৃদরোগে আক্রান্ত।
শিশুদের পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া পুতুলের সাথে পলক 
তারা এই সমস্ত শিশুদের অপারেশন করার জন্য ঐ বছরই একাধিক মঞ্চ পরিবেশনা করে এবং
প্রায় ২ লক্ষ ২৫ হাজার ভারতীয় মুদ্রা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। এই টাকা দিয়ে ৩৩ জনের
তো সম্ভব হয় নি। কিন্তু ৫ জন শিশুর অপারেশন সম্ভব হয়। শুরু হয় পলক মুচ্ছলের
শিশুদের বাঁচানোর এক অনন্য অভিযানের কথা।
পরবর্তী বছর ২০১১ সাল থেকে সারা ভারতে মঞ্চে গান পরিবেশনের মাধ্যমে অর্থ
সংগ্রহ করে “পলক মুচ্ছল হার্ট ফাউন্ডেশনের” মাধ্যমে শিশুদের সুস্থ্য করে তুলছেন।
উল্লেখ্য, তাদের এই মঞ্চ পরিবেশনের নাম ‘দিল সে দিল তাক’। বাংলায় হৃদয় থেকে হৃদয়ে।
আর ইংরেজীতে
`Save Little Heart’. মঞ্চে পলক মুচ্ছলের সাথে তার ছোট ভাই পলাশ মুচ্ছলও
পরিবেশন করে। একটি মঞ্চ পরিবেশনায় পলক গড়ে প্রায় ৪০ টি গান পরিবেশন করে। কিছু তার
নিজের গান। আর কিছু সিনেমার জনপ্রিয় গান। পলক মুচ্ছল প্রায় ১৭টি ভাষায় গান গাইতে
পারে। বর্তমানে সে বলিউড সিনেমার জনপ্রিয় একজন প্লেব্যাক সঙ্গীত শিল্পী।
মঞ্চে গান পরিবেশন করছেন পলক মুচ্ছাল

পলক গান গেয়ে যতো টাকা উপার্জন করে তার সবটুকুই সে তার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে
দরিদ্র শিশুদের চিকিৎসার কাজে ব্যয় করে। আগে যেখানে একটি শিশুর অপারেশনের জন্য
একাধিক মঞ্চ পরিবেশনা করতে হতো। বর্তমানে এখন ১ টি মঞ্চ পরিবেশনা থেকে ৭-৮টি শিশুর
অপারেশন করা সম্ভব হয়। ব্যস্ততার কারণে এখন সবগুলো অপারেশনের সময় শিশুটির পাশে না
থাকতে পারলেও- প্রতিটি অপারেশনের সময় সে প্রার্থনায় বসে প্রার্থনা করে।
ভাবতে অবাক লাগে যে বয়সে একটি মেয়ের পুতুল খেলে সময় পার করার কথা- তখন পলক
শিশুদেরকে সুস্থ্য করে তুলে সে পরিবারের কাছ থেকে একটি করে পুতুল উপহার হিসেবে
গ্রহণ করে। তাকে তার শৈশব কাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলে, “ঠিক আছে, যদিও আমি আমার
শৈশব হারিয়েছি। বন্ধুদের সাথে খেলার চেয়ে একটি জীবন বাঁচান বেশি গুরুত্বপূর্ণ।“     
পলক মুচ্ছলকে আগে থেকে সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে জানলেও তার এই অনন্য কাজ সম্পর্কে
প্রথম জানতে পারি দুইদিন আগে। তারপর থেকে ঘোরের মধ্যে আছি। কিভাবে সম্ভব- একজন ৭
বছরের শিশুর মধ্যে এই বোধ জাগ্রত হওয়া? কাল যখন আমি আমার স্ত্রীর সাথে এই গল্প
শুনিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- বলতো ঐ পরিবার গুলোর কাছে পলক মুচ্ছল কে? সে ছলছল চোখ বলল,
“একজন দেবী”।

হে দেবী! তুমি বেঁচে থাকো হাজারো বছর। বেঁচে থাকুক তোমার কণ্ঠ। আরা বেঁচে
থাকুক আরো লক্ষাধিক প্রাণ তোমার কন্ঠের বিনিময়ে। 

**লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় বারসিকনিউজডটকম

Recommended Posts