মাকে ভালোবাসি

আজ মা দিবস! পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও ইংরেজি বছরের মে মাসের ২য় রবিবারকে মা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এ বছর মে মাসের ২য় রবিবার ১৪ তারিখ হওয়ায় আজ ‘মা দিবস’। মা দিবস পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ দেশে পালিত হলেও সবদেশে কিন্তু একই দিনে পালিত হয় না। বছরের প্রায় ৩০টি ভিন্ন ভিন্ন দিনে পালিত হয় মা দিবস। অনেক দেশে বিশেষ করে পূর্বের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে নারী দিবসেই একসাথে ‘মা দিবস’ পালন করা হয়। সবাই যে আবার ইংরেজি ক্যাল্ডোর অনুসরণ করে তাও কিন্তু নয়। নেপাল যেমন বৈশাখ মাসের অমাবস্যাকে কেন্দ্র করে মা দিবস পালন করে; তেমনি ইরান ইসলামিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে ২০ জমাদিউস সানিতে আর ইসরাইল ২২ মে মা দিবস পালন করে থাকে। মা দিবস ঘিরে রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। বলা হয়ে থাকে এই দিবস উদযাপন নাকি পুঁজিবাদ এবং ব্যবসা বাণিজ্যের ফসল। কিন্তু মা দিবস বিংশ শতকের গোড়ার দিকে শুরু হলেও এর শিকড় প্রত্থিত রয়েছে সূদূর অতীতে। প্রাচীন গ্রিক, রোমান ও খ্রিস্টান সভ্যতায় মাতৃত্বকে ঘিরে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালনের প্রমাণ পাওয়া যায়।
আধুনিক মা দিবস পালনের পথিকৃত ধরা হয় যুক্তরাষ্ট্রের আনা মারিয়া রিভস জার্ভিসকে। তিনি তার মায়ের সম্মান এবং কাজকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ১৯০৮ সালে মা দিবস পালন করেন এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য জোর আন্দোলন চালান। তবে তার আন্দোলন একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অর্জন করে; অন্যদিকে এই দিবসকে ঘিরে বিভিন্ন কার্ড, চকলেট, বেকারি, গিফটসহ নানা প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ের প্রসার ঘটাতে থাকে। আনা মারিয়া রিভস জার্ভিস মা দিবসের এই ধরনের বাণিজ্যিকীকরণের তীব্র বিরোধিতা করে আন্দোলন চালান এবং গ্রেপ্তারও হন।
মা দিবস উদযাপন করা হয় মা, মাতৃত্ব, মাতৃত্বের বন্ধন এবং সমাজে মায়ের ভূমিকাকে স্বীকৃতি এবং সম্মান জানানোর জন্য। মা হওয়া কিংবা সন্তান জন্মদান এবং লালন-পালন স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক বিষয় হলেও সমাজ এবং সংস্কৃতির নির্মাণ, বিকাশ এবং টিকিয়ে রাখতে ‘মা’ এর ভূমিকাই অগ্রগণ্য। নতুন প্রজন্ম গর্ভে ধারণ, জন্মদান, বুকের দুধ খাওয়ানো, শিক্ষা দান, সামাজিকীকরণসহ অসংখ্য কাজ করে থাকেন একজন মা। একটি সমাজ, সংস্কৃতি এবং সভ্যতার বিকাশে তাই একেবারে পিছন থেকে প্রাথমিক এবং মূখ্য কাজগুলো সম্পাদন করে থাকেন একজন মা। তাই এটি মানব সমাজ এবং সভ্যতারই দায় এবং দায়িত্ব সেই ‘মা’ কে আলাদাভাবে বিশেষ সম্মান জানানো। পাশাপাশি, সমাজের যে সমস্ত সদস্য ‘মা’ কে অবহেলা, বঞ্চনা এবং নিপিড়ীন করে থাকেন তাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো মায়ের অবদান, ত্যাগ, ভালোবাসা, মমতাকে।  আর এটি করতে গিয়ে বছরের ৩৬৫ দিনের একটি দিন মায়ের নামে উৎসর্গ করলেও বা ক্ষতি কী!
তাই আসুন মাকে ভালোবাসি। অনেক ব্যস্ততার মাঝে ‘মা’ এর জন্য প্রতিদিন একটু সময় বের করি। ‘মা’র খোঁজ নিই। তার পাশে বসি। মা কিন্তু আমাদের কাছ থেকে প্রতিদান চান না, আদর চান না, কোন সেবা কিংবা কোন আবদারও হয়তো নেই। শুধু একটাই প্রত্যাশা- ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’
প্রাণ ও প্রকৃতির সবচেয়ে চিরন্তন, সংবেদনশীল এবং টেকসই কাজ হচ্ছে জন্মদান বা মাতৃত্ব। আর এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নারী। তাকে আমরা ‘মা’ হিসেবে সম্বোধন করে থাকি বা চিনে থাকি। সবচে’ মজার এবং আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে ‘মা’ এর অস্তিত্ব সকল প্রাণ এবং প্রকৃতিতে বিরাজমান। অনেক উদ্ভিদ এবং প্রাণ সমাজে বাবাকে চিহ্নিত করা সম্ভব না হলেও মা কে  চিহ্নিত করা সম্ভব। তাই তো প্রাণ এবং প্রকৃতির এক চিরন্তন সত্ত্বা হচ্ছে ‘মা’।
‘মা’ মানে মাটি। ‘মা’ মানে প্রাণ। ‘মা’ মানে প্রকৃতি; ‘মা’ মানে আমাদের এই পৃথিবী। আর এই পৃথিবী ‘মা’ এর সর্বশ্রেষ্ঠ (মানুষের দাবি অনুসারে) সন্তান যেহেতু মানুষ; তাই মানুষের দায় তার নিজের মানব ‘মা’ কে ভালোবাসা, সম্মান আর স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি মাটি ‘মা’কে, প্রাণ-প্রকৃতি ‘মা’কে সর্বোপরি এই পৃথিবী ‘মা’কেও ভালোবাসা, সম্মান আর স্বীকৃতি জানানোর। কারণ আমাদেরই ‘মা’ই যে আর সব ‘মা’ (মাটি, প্রাণ-প্রকৃতি, পৃথিবী) এর প্রতিরূপ। শুধু আমাদের মানব ‘মা’কে ভালো রাখলে কিন্তু হবে না। আমাদের মাটিকে ভালো রাখতে হবে, সকল প্রাণ এবং প্রকৃতিকে ভালো রাখতে হবে। এই পৃথিবীকেও সবুজ, শ্যামলে ভরে রাখতে হবে। তবেই আমাদের ‘মা’ও ভালো থাকবে। ‘মা’ যে মাটিতে হাঁটবেন, যে উদ্ভিদ এবং প্রাণী খেয়ে বাঁচবেন, যে পৃথিবীতে বুক ভরে নিশ্বাস নেবেন- সেগুলো যদি দূষিত, ধ্বংস আর বিষাক্ত হয়ে যায়; তাহলে ‘মা’ কি সুস্থ, সুন্দর আর দীর্ঘজীবী হয়ে আমাদের পাশে থাকবেন? কক্ষনোই নয়।

Recommended Posts