মানুষ তার শত্রু সমান বড়

কজন সত্যিকারের নায়ক বা হিরো কেবল তার গুণাবলির জন্যই বড় নয়; বরং তার প্রতিপক্ষ বা শত্রুর শক্তিমত্তাও তার বীরত্বের মাপকাঠি নির্ধারণ করে। যার শত্রু যত বড়, তার বীরত্বও তত বড় পরিসরে বিস্তৃত হয়। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রতিটি মহান বিপ্লব, প্রতিটি ঐতিহাসিক সংগ্রাম শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপরীতে দাঁড়িয়েই মহিমান্বিত হয়েছে।

এ কারণেই একজন বিপ্লবীর জন্য তার শত্রু বা প্রতিপক্ষ বেছে নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। যদি প্রতিপক্ষ দুর্বল হয়, তবে সেই লড়াইয়ের গুরুত্ব ও গভীরতা কমে যায়। কিন্তু যদি শত্রু প্রবল হয়, তবে সেই লড়াইও একটি বৃহৎ মাত্রা পায় এবং ইতিহাসের পাতায় বিশেষভাবে স্থান পায়।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবকে বড় করে দেখার মূল কারণ হলো, এটি যে শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে তা অত্যন্ত শক্তিশালী, সুসংগঠিত এবং দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতাধারী। আওয়ামী লীগ শাসনব্যবস্থা এবং এর একচ্ছত্র নেতৃত্বে থাকা শেখ হাসিনা এই বিপ্লবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা প্রধান প্রতিপক্ষ। এমনকি আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের বক্তব্যেও প্রকাশিত হয়েছে যে, তারা শেখ হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছেন।

একজন শাসকের প্রকৃত শক্তি তার বিরোধীদের দ্বারা নির্ধারিত হয়। শেখ হাসিনা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছেন এবং তার শাসনব্যবস্থা অত্যন্ত কঠোরভাবে বিরোধীদের দমন করেছে। এ কারণেই ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান এতটা বিস্তৃত হয়েছে এবং বড় রূপ নিয়েছে। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈপরীত্য রয়েছে—এই বিপ্লবের একজন প্রধান নায়ক নেই।

ইতিহাসে অনেক বিপ্লবে একজন নির্দিষ্ট নেতা বা নায়কের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছে, যিনি প্রতিপক্ষের সমতুল্য ছিলেন বা তার চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। কিন্তু ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। এখানে কোনো একক নায়ক নেই, বরং অনেকগুলো স্টেকহোল্ডার রয়েছে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের মধ্যে বিভক্ত। ফলে ছয় মাস পরেও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব অব্যাহত রয়েছে—কে আসলে বড় নায়ক, কারা প্রকৃত স্টেকহোল্ডার?

তবে একথা অনস্বীকার্য যে, শেখ হাসিনার মতো ক্ষমতাধর প্রতিপক্ষের সমতুল্য কোনো নায়ক এখনও আবির্ভূত হয়নি। এই বিপ্লবের অংশগ্রহণকারীরা হয়তো এককভাবে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের শক্তির সমকক্ষ হতে পারেনি, তবে তারা সম্মিলিতভাবে একটি গণবিপ্লবের চেহারা গড়ে তুলেছে। এ কারণেই একে গণঅভ্যুত্থান বলা হচ্ছে—এটি শুধুমাত্র কোনো নির্দিষ্ট দলের নয়, বরং সাধারণ মানুষের অভ্যুত্থান।

তবে, আজকের আলোচনার মূল উপজীব্য এই সমসাময়িক রাজনৈতিক পটভূমি নয়। বরং বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা যখন দেখি, তখন উপলব্ধি করি—একজন মানুষের মূল্যায়ন অনেকাংশে নির্ভর করে তার প্রতিপক্ষ বা চ্যালেঞ্জের মাত্রার ওপর। ব্যক্তি, সমাজ কিংবা জাতি—যার বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তার শক্তিমত্তা যত বড়, সেই সংগ্রামও তত মহৎ হয়ে ওঠে। তাই একজন বীরের সঠিক পরিচয় নির্ধারিত হয় তার শত্রুর পরিধির মাধ্যমে।

তাই আমাদের বন্ধুর চেয়ে- কে আমার শত্রু সেটা চিনে নেয়া জরুরী। আমার শত্রু হয় যদি – বাসার দারোয়ান, কাজের বুয়া, পাড়ার চাচা, সেই কমন আত্মীয়- যে সবকিছুতেই শুধু হিংসা করে আর ত্রুটি ধরে। কিংবা আমাদের ননদ- শাশুড়ি কিংবা প্রতিবেশি চাচা যে পায়ে লেগে ঝগড়া করে। তবে আমাদের অর্জন হবে তেমনটাই। অন্যদিকে আমাদের শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বী যদি এমন হয় যে- চিন্তা, চেতনায়, কৌশলে কিংবা অর্থে-বিত্তে আমার চেয়ে যোজন যোজন দূর; তবে আমাদের প্রস্তুতি, কৌশল এবং বিজয় টা হবে – অনেক বড় কালোত্তীর্ণ। Our victory will be larger than life.

আমাদের সেই গল্প-উপন্যাস বা সিনেমার হিরো/নায়কের (Protagonist) কথাই বেশি মনে পড়ে- যে গল্প, উপন্যাস, সিনেমার ভিলেন (Antagonist) বা খল চরিত্র যতো বড় আর বিশাল। শোলে সিনেমা তাই গাব্বার চরিত্র হয়ে ওঠে অন্যতম। রামায়ণে তাই রাবণ; বিষাদ-সিন্ধুতে তাই এজিদ চিরস্মরণীয়। ইতিহাসে মুখ্য হয়ে ওঠে হিটলার।

সুতরাং কে আমার শত্রু হবে? কে হবে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী- সেটা চিহ্নিত করা অনেক জরুরী। অথবা এমন কাউকে বেঁছে নেয়া- যে আমার বেঞ্চমার্ক হবে। যাকে আমরা অতিক্রম করবো। তবেই আমার আমি শানিত হবো; দক্ষ হয়ে উঠবো।

কিন্তু আমরা করি উল্টোটা। আমরা আমাদের প্রতিদিনের এনার্জি আর মেধা নষ্ট করি- অফিসের কাজ ফাঁকি দেয়া কলিগের সাথে লড়াইয়ে। বাসের কন্ট্রাক্টর, রিকশাওয়ালা, সব্জিওয়ালা র সাথে অহেতুক ঝগড়া করে। আমাদের এনার্জি ব্যায় করি এমন ছোট-ছোট কাজে যা- আমাদেরকে বড় হতে বাধাঁ দেয়। আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি এমন ছোট ছোট শ্ত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে।

আমাদের ইগোতে লাগে আমার আশেপাশের গুরুত্বহীন মানুশগুলোরে অহেতুক মন্তব্যে। মাঝে মাঝে আমরা হতাশ হয়ে পড়ি আমার পাশের মানুষটি যখন আমার চেয়ে ভালো করতে থাকে। কিংবা মন খারাপ করি- এমন কোন মানুষের কটু কথায়- যাকে চিনি না; জীবনে আর কক্ষনো দেখা হবে কি না জানা নেই। সেই মানুষটার কথায় আদৌ কি কোন কিছু যায় আসে?

তাহলে সমাধান কী? সহজ কথায়- ইগ্নোর করা। পাত্তা না দেয়া। ফোকাস ঠিক রাখা। আমাদের তার কথারই গুরুত্ব দেয়া উচিৎ- যে আমার জীবনে কোন ইমপ্যাক্ট রাখে বা রাখবে। আমাদের এমন বিষয়ের প্রতি মনযোগ দেয়া উচিৎ- যেটা অধিক গুরুতবপুর্ণ। বাসায় এসে চাল-তেল-নুনের দাম বৃদ্ধি নিয়ে বউয়ের সাথে রাগারাগি না করে কিভাবে এই ক্রমবর্ধ্মান মুল্যস্ফীতির সাথে পাল্লা দেয়া যায়- সেটা নিয়েই পরামর্শ করা উচিৎ পার্টনারের সাথে। কোন দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায় কিনা? নতুন কোন বিজনেস শুরু করা যায় কিনা? কিংবা বিশ্লেষণ করা উচিত – আয় আর ব্যয়ের। কিভাবে খরচ কমানো যায়- এমন কোন খাত খুঁজে বের করা।

অন্যদিকে আমরা যখন কোন প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হই- তখন বিরক্ত হই, দমে যাই, পালিয়ে যাতে চাই। ভাবি- আমার সাথেই কেন বার বার এমনটাই হয়? আমি কি কোন ভাবে অবহেলা কিংবা বঞ্চনার শিকার হচ্ছি? বরং আমাদের ভাবো উচিৎ- এই পরিস্থিতি আমাকে আরো বেশি- পরিশুদ্ধ করে তুলবে। যখনই আমরা প্রতিকূল পরিবেশে পড়ি; নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই- সেটাকে সমাধানের মাধ্যমে আরো দক্ষ হয়ে উঠি। নিজেকে আরো পরিশীলিত করা যায়।

তাই সেলিব্রেট করা উচিৎ- আমাদের দুঃসময়কে, কঠিন মুহুর্তকে। কেননা এই মুহুর্ত আর সময়কে অতিক্রম করেই আমরা আমাদের ব্যাক্তিগত জীবনে বিজয়ী হই। একইভাবে আমাদের শত্রুকে/প্রতিদ্বন্দ্বীকেও মনে রাখা দরকার। তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলা দরকার- Thank you! Your challenges make my journey remarkable.

তাই বন্ধুর চেয়ে শত্রু গুরুত্বপূর্ণ। তাই বড় বন্ধু নির্বাচনের চেয়ে বড় শত্রু বাছাই করা জরুরী। বন্ধুর সহায়তা দুর্বল করে তোলে আর শত্রুর আঘাত দক্ষ আর শানিত করে তোলে। তাই কে আমার শত্রু কিংবা আমি কাকে শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করবো- সেটা গুরুত্বপুর্ণ।

Recommended Posts