বীজ বিদ্যাপীঠের অনেকগুলো ‘না’

শিক্ষা জীবনে শিখে ছিলাম ‘রিজিড’ (rigid) হওয়া যাবে না। উদার হতে হবে, কঠোর হওয়া যাবে না। কিন্তু বীজ বিদ্যাপীঠ এসে শিখলাম কোন একটি দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটু নয় অনেক বেশি রিজিড হতে হয়। বীজ বীদ্যাপীঠে অনেকগুলো ‘না’ শিখবেন।  প্রথম ‘না’ তো আগেই বলেছি ‘এখানে কোক এবং পেপসি খাওয়া নিষেধ’। এগুলো নিষেধ হওয়ার কারণ যতটা না এর স্বাস্থ্যগত দিক তার চেয়ে বেশি। এই কোম্পানি দুটির সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র। পাশপাশি, ইন্ডিয়ায় এই কোম্পানির বিরুদ্ধে ‘নবধান্যিয়া’ সফল আন্দোলনের ইতিহাস। উত্তরাখণ্ডে একটি এলাকায় কোকা কোলা কোম্পানি একটি ফ্যাক্টরি তৈরি করতে গেলে তার আশু প্রভাব পরে এলাকার পানি সম্পদ এবং পরিবেশ এর উপর। সেই সময় নবধান্যিয়া এলাকার জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে সেই ফ্যাক্টরি বন্ধ করতে সক্ষম হয়। এখন যাদের বিরুদ্ধে আন্দলোন করা তাদের পণ্য ভোগ করা বা করতে দেয়া স্ববিরোদ্ধিতা। পাশাপাশি এখানে আসা প্রতিটি শিক্ষার্থী এই ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে। তাদের মধ্যে একটি ইতিবাচক প্রভাব পরে এই রিজিড বা কঠোর হওয়ার বদৌলতে।
দ্বিতীয় না হচ্ছে এখানে থালা-বাসন ধোয়ার জন্য কোন ডিটারজেন্ট বা কোন ক্যামিকেল ব্যবহার করা হয় না। এখানে রিঠা ফলকে পানিতে সিদ্ধ করে এক ধরনের তরল তৈরি করা হয়। সেটিই ব্যবহার করা হয়।
প্রথমেই উল্লেখ করেছি, এই খামারের একটি বড় অংশ আম বাগান। সেই আমবাগানের বেশিরভাগ অংশটাই লিজ দেওয়া। রাতে সেখানে প্রায় পটকার আওয়াজ পাওয়া যেত। হঠাৎ হঠাৎ চমকে যেতাম। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আম বাগানে এই সময় প্রচুর পাখি আসে আর পাখি তাড়ানোর জন্য পটকা (বাজি) ফুটানো হয়। কারণ এই আম বাগানে কোন ধরণের কীটনাশক ব্যবহার নিষেধ। এমন শর্তেই বাগানটাকে লিজ দেয়া হয়েছে। এই কারণে বাজারের থেকে অনেক কম মুল্যেই লিজ দেয়া হয়েছে। আর  আম বাগানের যে অংশটুকু লিজ দেয়া হয়নি সেখানে পাখি তাড়ানোই হয় না। গাছে আমে ভরপুর গাছে বক পাখির আস্তানা। পাখি আম খাচ্ছে তবুও তাড়ানোর জন্য কোন ধরণের আগ্রহই নেই। এই পাখি গুলো আমে পোকা থেকে রক্ষা করছে।
প্লাস্টিক একদমই না। পুরা খামারে প্লাস্টিক না ব্যবহারের এক ধরণের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যতক্ষণ পারা যায় প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় না। পুরা খামারে কয়েকটি পাপোস এবং টয়লেট পরিষ্কার করার ব্রাশ ছাড়া আর কিছুই প্লাস্টিকের চোখে পরেনি। এমনকি ডাস্টবিনের জন্যও প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় না।
এই বিশাল খামার চাষা করার জন্য ট্র্যাক্টর নয়। গরু টানা লাঙ্গল ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহারের চেয়ে শ্রম, জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা ব্যবহারের প্রতি বেশি গুরুত্ব ব্যবহার করা হয়।
এসি কিংবা ফ্রিজ নেই। পানি ঠান্ডা রাখার জন্য মাটির পাত্র। ফ্রিজ এর চেয়ে টাটকা খাবার এবং সবজিকে উৎসাহ প্রদান করা হয়। অন্যান্য খাবার সংরক্ষণের জন্য ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
রাসায়নিক সার, কীটনাশক, দেশীয় জাতের বীজ ছাড়া অন্য কোন বীজ ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। রাসয়নিক সারের পরিবর্তে কেঁচো সার, পিট কম্পোস্ট, ম্যানিওর ব্যবহার করা হয়। রাসায়নিক কীটনাশক এর পরিবর্তে পাখি এবং জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা হয়।
বীজ ঘরের বীজকে ইঁদুর থেকে রক্ষা করার জন্য বিড়াল পোষা হয়। পাশাপাশি বীজ বিদ্যাপীঠের এলাকায় ধূমপান এবং মদ্যপান একদমই নিষেধ।
এই ধরণের কিছু ‘না’ এর মাধ্যমে বীজ বিদ্যাপীঠ এক অনন্য পরিচয় লাভ করেছে। এই সমস্ত ছোট ছোট বিষয়ের সাথে আপোষ না করার ফলে এটি সারা ভারতে এমনকি সারাবিশ্বে অরগানিক খামারের এক আদর্শ উদাহরণ। সারা ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য শিক্ষার্থী এই বীজ বিদ্যাপীঠ এ ইন্টার্নশিপ, স্বেচ্ছাসেবক এবং বিভিন্ন কোর্স করতে আসে।

বীজ বিদ্যাপীঠ এর শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপদ্ধতি

‘নবধান্যিয়া’ শব্দের অর্থ হচ্ছে নয়টি শস্য বীজ। নব=৯ আর ধান্যিয়া= শস্যবীজ। এটি একটি জীব বৈচিত্র্য খামার (Bio-Diversity  Firm)। একই সাথে এটি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের-নাম ‘বীজ বিদ্যাপীঠ’ ইংরেজিতে বলা হয় ‘Earth University’। এই প্রতিষ্ঠানটির দাবি অনুযায়ী এটি একটি অর্গানিক বা জৈব কৃষি শিক্ষার আদর্শ স্থান।
বীজ বিদ্যাপীঠ এর শিক্ষার্থী মূলত চার ধরনের।
ক) ইন্টার্ন- যাদেরকে কমপক্ষে ১ মাস বিদ্যাপীঠে অবস্থান করতে হবে।
খ) বিভিন্ন কোর্সের শিক্ষার্থী
গ) স্বেচ্ছাসেবক
ঘ) দর্শনার্থী- যারা এক মাসের কম বিদ্যাপীঠে অবস্থান করে।
এই চার ধরনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম দুই ধরনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রুটিন রয়েছে। শিক্ষার ধরণ সম্পূর্ণ হাতে কলমে। শিক্ষার্থীদের আবাসিক অবস্থান বাধ্যতামূলক। দিন শুরু হয় সকাল ৬ টায়। ৬টায় থেকে ৭টা পর্যন্ত মেডিটেশন। ৭টায় ভেষজ চা। এরপর সকাল ৮টা পর্যন্ত বিরতি। এর মধ্যেই অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ করতে হবে। কেননা ৮ থেকেই মূলত শিক্ষার্থীদের ব্যস্ততা শুরু হয়। সকাল ৮ থেকে ৮ টা ৩০ পর্যন্ত সকালের নাস্তা। ৮টা ৪৫ থেকে মর্নিং গ্যাদারিং(সকালের স্মাবেশ)। এই অধিবেশনে অনেক গুলো কাজ করা হয়। প্রথমত, একটি উক্তি এবং সেটির অন্তর্নিহিত বক্তব্য দিয়ে শুরু হয়। তারপর একটি খেলা কিংবা কাজ; যেটি সবাই মিলে যেন করতে পারে। এই অধিবেশনের সবশেষে দিনের সবার একটি প্রার্থনা বা আশা প্রকাশ করা হয়। যেমনঃ আজ যেন বৃষ্টি হয়, গরম যেন কম পড়ে, প্রভৃতি।
সকাল ৯ টায় শুরু হয় ‘শ্রমদান’। এই শব্দটি মহাত্মা গান্ধীর জীবন ও দর্শন থেকে নেয়া। ‘শ্রমদান’ শব্দের অর্থ হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা। বীজ বিদ্যাপীঠের কোন একটি অংশকে সবাই মিলে পরিষ্কার করার নামই হচ্ছে ‘শ্রমদান’। এটি অবশ্যপালনীয় একটি কাজ। ১০টা থেকে ১২ টা মূলত হাতে-কলমে বীজ বিদ্যপীঠের খামারে কাজ করা। মাঝখানে ১১টায় রয়েছে চা অথবা শরবতের বিরতি। এই ২ ঘণ্টা কাজ করতে হবে খামারে কীভাবে জৈব উপায়ে চাষাবাদ করা যায় সেই জিনিসগুলো। কোন দিন, জমি প্রস্তুত, কোন দিন বীজ সংগ্রহ আবার কোন দিন চারা বা বীজ বপন। এটা শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে করতে হয় না। খামারের কর্মচারীরা যেদিন যে কাজ করে সেই কাজে সহযোগিতা এবং শিখে নেওয়াই এই অধিবেশনের মূল লক্ষ্য। তবে প্রতিদিন যে খামারের কাজে সহযোগিতা করতে হয় এমনটা নয়। নিজে নিজে শিক্ষার্থীদের কৃষি কাজ করার জন্য রয়েছে আলাদা জায়গা; যার নাম “জ্ঞান গার্ডেন”।
‘জ্ঞান গার্ডেন’ একটি নাশপাতি গাছকে ঘিরে গোলাকার একটি জায়গার নাম জ্ঞান গার্ডেন। এখানে হাতে-কলমে এবং পঠিত বিষয় শিখে প্রয়োগ করার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করা হয় বলে এই বাগানের নাম জ্ঞান গার্ডেন। এই বাগানের কোন কাজই খামারের কর্মচারী করেন না। এখানের সব কাজই করতে হয় এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের। মাঠ প্রস্তুত থেকে শুরু করে বীজ বপন এমনকি ফসল উত্তোলন করে বিদ্যপীঠে আগত বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের। একটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা হয়তো বীজ বপন করে গেলো আর এক ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এসে হয়তো সেই ফসল উত্তোলন করছে। শিক্ষার্থীরা এই বিদ্যাপীঠ ত্যাগ করলেও ফোনে কিংবা বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে খবর রাখে তাদের জ্ঞান গার্ডেনের ফসলের।
১২ টা থেকে ১টা পর্যন্ত গোসল এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ করার সময়। ১টা থেকে ২ টা দুপুরের খাবার। ২টা থেকে ৩টা বিরতি। ৩টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত ক্লাস বা তাত্ত্বিক আলোচনা। এই সময়ে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা হয়।
৫টায় চা বিরতি এবং ৫ টা থেকে ৮টা পর্যন্ত ফ্রি সময়। এই সময় খেলাধুলা এবং অন্যান্য বিনোদন এর জন্য। ৮টায় রাতের খাবার। ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত আড্ডা, আলোচনা, পড়াশুনা। তবে রাত ১০ টা থেকে পরদিন সকাল ৬টা হচ্ছে নিরব সময়। এই সময় রুমে বসে পড়াশুনা কিংবা অন্যান্য কাজ করা যাবে। তবে অন্য কারো অসুবিধা হয় এমন কোন কাজ করা যাবে না।
এই রুটিন পড়ে মনে হতে পারে এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ-পদ্ধতি কোথায়? বীজ বিদ্যাপীঠ ক্লাস রুমভিত্তিক শিক্ষা দানের চেয়ে হাতে-কলমে এবং উন্মুক্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে শিখুক। তাহলে তাদের মধ্যে এই জানার প্রভাবটা গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী হবে। আপনি হয়তো দুপুরের খাবার খেতে খেতে কারো সাথে জৈব কৃষির বাজারজাতকরণের বিষয়গুলো নিয়ে কথা বললেন। কিংবা বিকালের চা খেতে খেতে জেনে নিলেন বীজ বিদ্যাপীঠের ইতিহাস এবং দর্শন।
সপ্তাহের কোন দিন কোন বিষয়গুলো নিয়ে গুরুত্ব দেয়া হবে সেটিও নির্ধারণ করা আছে এখানে। যেমন ভারতে সপ্তাহ শুরু হয় সোমবারে। আর সোমাবারে শেখার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হবে চিকিৎসা (ভেষজ), মঙ্গলবার বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, বুধবারে দক্ষতা বিনিময়(আপনি হয়তো কোন গান, কিংবা ভালো হাতের কাজ পারেন সেটি সবার সাথে শেয়ার করবেন), বৃহস্পতিবার ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী, শুক্রবারে সবাই মিলে রান্না করা, শনিবার মুলত শিক্ষার্থীদের নিজের জন্য (জামাকাপড় পরিষ্কার, নিজের ঘর গোছানো, প্রভৃতি)। আর সবচেয়ে মজার দিন হচ্ছে রবিবার-এদিন শুধুই বিনোদন। ওখনাকার ভাষায় “সানডে-ফানডে”।
এখানকার মূল বিশয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য হয়তো নির্ধারিত একজন আলোচক থাকে; তাছাড়া ওখানের সবার কাছ থেকে আপনি শিখতে পারেন। যিনি জমি চাষ করেন তার কাছ থেকে শিখে নেন কীভাবে জমি প্রস্তুত করতে হয়। যিনি বীজ সংরক্ষণকারী তার কাছ থেকে শিখে নেন বীজ সংরক্ষণ এর বিষয় গুলো। পাশাপাশি এখানে রয়েছে পাঠাগার-আপনি ইচ্ছে হলে সেখানে বসে পড়ে নেন যে বিষয়টি সম্পর্কে আপনি বিস্তারিত জানতে চান।
শেখাটা এখানে তাই পড়া এবং শুনা একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি চর্চা, প্রতিদিনকার নিত্যনৈমিত্তিক কাজের মধ্য দিয়ে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করার বিষয়। আপনি হয়তো কিছু খাচ্ছেন-খাওয়ার মধ্য দিয়ে জেনে নিন কি খাচ্ছেন? কেন খাচ্ছেন? কি খাওয়া উচিত? হয়তো চিন্তা করছেন-এমন কোন চিন্তা করুন যেটি একজন কৃষক করে। পানি খাচ্ছেন খান যেভাবে খাওয়া উচিত-মাটির পাত্রে; বোতলজাত নয়।

একটি বীজ বিদ্যাপীঠ

‘নবধান্যিয়া’ শব্দের অর্থ হচ্ছে নয়টি শস্য বীজ। নব=৯ আর ধান্যিয়া= শস্যবীজ। এটি একটি জীব বৈচিত্র্য খামার (Bio-Diversity  Firm)। একই সাথে এটি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের-নাম ‘বীজ বিদ্যাপীঠ’ ইংরেজিতে বলা হয় ‘Earth University’। এই প্রতিষ্ঠানটির দাবি অনুযায়ী এটি একটি অর্গানিক বা জৈব কৃষি শিক্ষার আদর্শ স্থান।
প্রতিষ্ঠান এর নাম কেন নয়টি শস্য? এমন প্রশ্ন মাথায় আসা স্বাভাবিক। পরে জানলাম ‘নবধান্যিয়া’ এর শুরুর সময় প্রতিষ্ঠাতা ‘বন্দনা শিবা’ এই রামগড় গ্রামে দেশীয় বীজ সংগ্রহের জন্য বের হন। সারা দিন ঘুরে তিনি নয়টি শস্য বীজ সংগ্রহ করেন। তিনি লক্ষ্য করেন দেখেন ৯ সংখ্যাটি একটি টেকসই বা স্থায়িত্বশীল সংখ্যা। গণিতের সর্বোচ্চ অঙ্ক। তাছাড়া ৯ সংখ্যাটিকে যত বার গুন করা হোক না কেন সেখানে ৯ এর অস্তিত্ব থাকবেই। যেমনঃ ৭X৭=৪৯; এখানে যেমন ৯ আছে। তেমনি ৭X৯=৬৩; ৬+৩=৯। ‘নবধান্যিয়া’ এর লোগো হচ্ছে ইংরেজি ৯; যা আবার বীজ দিয়ে তৈরি। এখানকার অনেক কিছুই ‘নবধান্যিয়া’ লোগো এর সাথে মিল রেখে করা হয়েছে। ‘নবধান্যিয়া’ এর নামকরণ এর ঘটনা কাকতালীয় মনে হলেও তারা এই নামটাকে যৌক্তিক এবং অর্থবোধক করে তুলেছে।
Navadhanya-1
ভারতের উত্তরাখণ্ড প্রদেশের রাজধানী শহর দেরাদুন থেকে ১৬ কিমি দূরে রামগড় গ্রামে ৪৫ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রবেশের শুরুতেই পড়বে বিশাল আম বাগান। মনে হবে বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জের কোন আম বাগানে প্রবেশ করছি। ৫ মিনিট হাটার পরে চোখে পড়বে প্রবেশ দ্বার ‘বীজ বিদ্যাপীঠে স্বাগতম’।
প্রবেশের পর প্রথেমেই একটি লেখাতে চোখ আঁটকে গেল ‘Coke Pepsi Free Zone’. পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার বের হয়ে এসে স্বাগত জানালেন। এবং সহকর্মীর মাধ্যমে আমার রুম দেখিয়ে দিলেন। এটি কোন বড় বিল্ডিং নয়। ছোট ছোট একতলা ঘর। বাইরে থেকে প্লাস্টার বিহিন ইটের দেয়ালে লাল রঙ। কিন্তু ভিতরে প্রবেশের সাথে সাথে দ্বিধায় পরে গেলাম। কেননা ভেতর দেখে দেখে মনে হল মাটির দেয়াল। মাটি দিয়ে লেপা। পরে হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখলাম ইটের দেয়ালের ওপরে প্লাস্টার এবং রঙ না করে মাটি দিয়ে লেপানো। কিন্তু টয়লেট একবারে সুন্দর এবং আধুনিক।
guest house
যাইহোক, ফ্রেশ এবং অন্যান্য কাগুজে কাজ শেষে বের হলাম ‘নবধান্যিয়া জীব বৈচিত্র্য খামার/বীজ বিদ্যাপীঠ’ পরিদর্শনে। ম্যানেজার জে পি কালি পরিচয় করিয়ে দিলেন চন্দ্র শেখর ভাট এর সাথে। উনি কিছু ছেলে-মেয়েদের সাথে কাজ করছিলেন একটি মাঠে। ছেলে-মেয়েদের সাথে পরিচিত হয়ে জানতে পারলাম তারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছে এখানে ইন্টার্নশীপ করার জন্য। প্রথমে পরিচিত হলাম লিয়াট এর সাথে আমেরিকা থেকে ভারতে এসেছে ইন্টার্নশীপ করার জন্য। এটি তার গ্রাজুয়েশন এর একটি অংশ। তারপর শিবম; সবচেয়ে ছোট। দশম শ্রেণীতে অধ্যয়ন করে-দেরাদুনেই পড়ে। ওর গরমের ছুটিতে এসেছে এখানে এক মাসের জন্য। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি ‘নবধান্যিয়া’ থেকে এমন কোন একটি জিনিস শিখেছ যেটি তোমার সারাজীবনের জন্য কাজে লাগবে?’ ও বলল, ‘এখানে আসার পূর্বে আমি খুব দুষ্ট ছিলাম। কিন্তু, এখানে আসার পর আমি কেমন জানি বদলে গেছি।” গত সপ্তাহে রবিবারের ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখন আমাকে সবাই দেখে বলল, আমি নাকি ভালো হয়ে গেছি। এখানে এসে আমার কৃষির প্রতি আকর্ষণ জন্মেছে। আমি পড়াশুনা শেষ করে আমার বাবার সাথে কৃষি কাজ শুরু করবো’।
interns
এর পরে পতিতপাবন চৌধুরী ওহম; ওড়িশ্যা থেকে এসেছে। সে ওড়িশ্যার একটি কলেজ থেকে বিবিএ করছে শেষ বর্ষের ইন্টার্নশীপ এর অংশ হিসেবে বীজ বিদ্যাপীঠ এ এক মাসের জন্য এসেছে। ওর আগ্রহের জায়গা মানব সম্পদ। ওর কৃষি এবং কৃষকদের নিয়ে একটি ড্রিম প্রজেক্ট রয়েছে এবং সেটি অর্গানিক কৃষিকে কেন্দ্র করেই।
ওহম এর সাথে ওর বন্ধু ধিরাজ মিশ্রা। কলকাতার ছেলে হলেও ওড়িশ্যায় বেড়ে ওঠা। ওর আগ্রহের জায়গা অর্গানিক কৃষির মার্কেটিং নিয়ে।
এই ৪জন ইন্টার্নকে সমন্বয় করছেন মিস প্রীতি। উনি পিএইচডি করছেন। পাশাপাশি বীজ বিদ্যাপীঠ এ প্রতিবেশ গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। আমি বাংলাদেশ থেকে ৩ দিনের জন্য এই টিমের সাথে মিশে গিয়ে তাদের প্রতিদিনের কাজের সঙ্গী হলাম। এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলাপ হবে।
gazibo
চন্দ্র শেখর ভাট, আঞ্চলিক সমন্বয়কারী আমাকে নিয়ে পুরো খামার ঘুরিয়ে নিয়ে দেখাতে বের হলেন এবং পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন খামার অন্যান্য কর্মীদের সাথে।পুরো খামারটি ৪৫ একর। একটি বড় অংশ আম বাগান। আম বাগানের ভিতরে থাকার জন্য কুঠির; এছাড়া প্রশাসনিক কাজের জন্য কয়েকটি কুঠির এবং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় ডরমেটরি। সকালের মেডিটেশন, আড্ডা কিংবা অনানুষ্ঠানিক সভার জন্য রয়েছে খড়ের চালার গোলাকার ঘর। এই ঘরটির নাম গাজিবো। এটি সংস্কৃত এবং বুদ্ধ ধর্মের যৌথ সম্মিলন। শ্রদ্ধায় অবনত জ্ঞান কেন্দ্র। এখানে উন্মুক্ত জ্ঞান আহরণের সুযোগ তৈরি হয় বলে এমন নাম। গাজিবো নিয়ে মুগ্ধ হলাম যখন জানলাম- এটি তৈরি করা হয়েছে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ট্যাঙ্কের উপর। এর সাথে ডরমেটরির ছাঁদ এর সাথে সংযোগ রয়েছে। সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এর চেয়ে ভালো হতো বলে আমার জানা নেই। যখন পানির সংকট থাকে তখন এই বৃষ্টির পানি ব্যবহার করা হয়।  (চলবে…)