শিক্ষা জীবনে শিখে ছিলাম ‘রিজিড’ (rigid) হওয়া যাবে না। উদার হতে হবে, কঠোর হওয়া যাবে না। কিন্তু বীজ বিদ্যাপীঠ এসে শিখলাম কোন একটি দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটু নয় অনেক বেশি রিজিড হতে হয়। বীজ বীদ্যাপীঠে অনেকগুলো ‘না’ শিখবেন। প্রথম ‘না’ তো আগেই বলেছি ‘এখানে কোক এবং পেপসি খাওয়া নিষেধ’। এগুলো নিষেধ হওয়ার কারণ যতটা না এর স্বাস্থ্যগত দিক তার চেয়ে বেশি। এই কোম্পানি দুটির সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র। পাশপাশি, ইন্ডিয়ায় এই কোম্পানির বিরুদ্ধে ‘নবধান্যিয়া’ সফল আন্দোলনের ইতিহাস। উত্তরাখণ্ডে একটি এলাকায় কোকা কোলা কোম্পানি একটি ফ্যাক্টরি তৈরি করতে গেলে তার আশু প্রভাব পরে এলাকার পানি সম্পদ এবং পরিবেশ এর উপর। সেই সময় নবধান্যিয়া এলাকার জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে সেই ফ্যাক্টরি বন্ধ করতে সক্ষম হয়। এখন যাদের বিরুদ্ধে আন্দলোন করা তাদের পণ্য ভোগ করা বা করতে দেয়া স্ববিরোদ্ধিতা। পাশাপাশি এখানে আসা প্রতিটি শিক্ষার্থী এই ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে। তাদের মধ্যে একটি ইতিবাচক প্রভাব পরে এই রিজিড বা কঠোর হওয়ার বদৌলতে।
দ্বিতীয় না হচ্ছে এখানে থালা-বাসন ধোয়ার জন্য কোন ডিটারজেন্ট বা কোন ক্যামিকেল ব্যবহার করা হয় না। এখানে রিঠা ফলকে পানিতে সিদ্ধ করে এক ধরনের তরল তৈরি করা হয়। সেটিই ব্যবহার করা হয়।
প্রথমেই উল্লেখ করেছি, এই খামারের একটি বড় অংশ আম বাগান। সেই আমবাগানের বেশিরভাগ অংশটাই লিজ দেওয়া। রাতে সেখানে প্রায় পটকার আওয়াজ পাওয়া যেত। হঠাৎ হঠাৎ চমকে যেতাম। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আম বাগানে এই সময় প্রচুর পাখি আসে আর পাখি তাড়ানোর জন্য পটকা (বাজি) ফুটানো হয়। কারণ এই আম বাগানে কোন ধরণের কীটনাশক ব্যবহার নিষেধ। এমন শর্তেই বাগানটাকে লিজ দেয়া হয়েছে। এই কারণে বাজারের থেকে অনেক কম মুল্যেই লিজ দেয়া হয়েছে। আর আম বাগানের যে অংশটুকু লিজ দেয়া হয়নি সেখানে পাখি তাড়ানোই হয় না। গাছে আমে ভরপুর গাছে বক পাখির আস্তানা। পাখি আম খাচ্ছে তবুও তাড়ানোর জন্য কোন ধরণের আগ্রহই নেই। এই পাখি গুলো আমে পোকা থেকে রক্ষা করছে।
প্লাস্টিক একদমই না। পুরা খামারে প্লাস্টিক না ব্যবহারের এক ধরণের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যতক্ষণ পারা যায় প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় না। পুরা খামারে কয়েকটি পাপোস এবং টয়লেট পরিষ্কার করার ব্রাশ ছাড়া আর কিছুই প্লাস্টিকের চোখে পরেনি। এমনকি ডাস্টবিনের জন্যও প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় না।
এই বিশাল খামার চাষা করার জন্য ট্র্যাক্টর নয়। গরু টানা লাঙ্গল ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহারের চেয়ে শ্রম, জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা ব্যবহারের প্রতি বেশি গুরুত্ব ব্যবহার করা হয়।
এসি কিংবা ফ্রিজ নেই। পানি ঠান্ডা রাখার জন্য মাটির পাত্র। ফ্রিজ এর চেয়ে টাটকা খাবার এবং সবজিকে উৎসাহ প্রদান করা হয়। অন্যান্য খাবার সংরক্ষণের জন্য ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
রাসায়নিক সার, কীটনাশক, দেশীয় জাতের বীজ ছাড়া অন্য কোন বীজ ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। রাসয়নিক সারের পরিবর্তে কেঁচো সার, পিট কম্পোস্ট, ম্যানিওর ব্যবহার করা হয়। রাসায়নিক কীটনাশক এর পরিবর্তে পাখি এবং জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা হয়।
বীজ ঘরের বীজকে ইঁদুর থেকে রক্ষা করার জন্য বিড়াল পোষা হয়। পাশাপাশি বীজ বিদ্যাপীঠের এলাকায় ধূমপান এবং মদ্যপান একদমই নিষেধ।
এই ধরণের কিছু ‘না’ এর মাধ্যমে বীজ বিদ্যাপীঠ এক অনন্য পরিচয় লাভ করেছে। এই সমস্ত ছোট ছোট বিষয়ের সাথে আপোষ না করার ফলে এটি সারা ভারতে এমনকি সারাবিশ্বে অরগানিক খামারের এক আদর্শ উদাহরণ। সারা ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য শিক্ষার্থী এই বীজ বিদ্যাপীঠ এ ইন্টার্নশিপ, স্বেচ্ছাসেবক এবং বিভিন্ন কোর্স করতে আসে।