বাংলাদেশের মত দরিদ্র দেশে রোগব্যধির প্রকোপ অধিক, কিন্তু রোগ নিরাময়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনাই অপ্রতুল। আধুনিক চিকিৎসার যাবতীয় সুবিধা গ্রামঞ্চলে অনুপস্থিত। তাই কেউ কোন ব্যধিতে আক্রান্ত হলে গাছপালার শেকড়, পাতা, ছাল ইত্যাদি থেকে চিকিৎসা করার প্রথা আবহমানকাল ধরেই চলে এসেছে। গাছগাছালির ঔষধি জ্ঞান আমাদের জনগোষ্ঠীর সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। এই অভিজ্ঞতা এক নিবিড় মৌলিক প্রক্রিয়ায় এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সঞ্চারিত হচ্ছে।
২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে নূন্যতম প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পৌছে দেয়া সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্য নীতির মূল লক্ষ্য ছিল। এই লক্ষ্যে বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামোগত উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও বিগত বছরগুলোতের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির আশানুরুপ উন্নয়ন ঘটেনি। আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতির একটি সীমাবদ্ধতা হলো স্বাস্থ্যসমস্যার সাথে সম্পর্কিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো বিবেচনায় না আনা। অথচ আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি, প্রত্যাহিকতা, বিদ্যমান বিশ্বাস, মূল্যাবোধ ও সংস্কারসমূহ বিবেচনা করা হলে এরা রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা কার্যক্রমে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
আমাদের গ্রামীণ সমাজে বিচিত্র রকমের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত আছে। গ্রামের সহজ সরল মানুষ তাদের রোগ মুক্তির ক্ষেত্রে লোকায়ত জ্ঞানের উপর নির্ভর করে। তারা মনে করে রোগব্যাধি জীবনের একটি অংশ এবং অনেক রোগকে তারা রোগ বলে মনে করেনা। আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণেও রয়েছে তাদের অনীহা। তাছাড়া আমাদের দেশের আধুনিক চিকিৎসা কাঠামো বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত নয়। তারা রোগ ব্যাধিতে প্রথমেই পরিবারের কারো পরামর্শ নেয়। গ্রামের কোন অসুস্থ মানুষ; তাদের নাগালে থাকা বিচিত্র চিকিৎসার ধরণ থেকে কোনটি বেছে নেবে তা অনেকগুলো শর্তের উপর নির্ভর করে। যেমন: তাদের সামাজিক অবস্থান, ঐ চিকিৎসার ব্যাপারে তাদের আস্থা, মূল্যবোধ, রোগের কারণ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা, ধর্মীয় অবস্থান, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইত্যাদি।
গ্রামবাসীর স্বাস্থ্য সচেতনতা:
স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে গ্রামের জনগোষ্ঠী মোটেও যত্নশীল নয়। অসচেতনতা এবং আরো বিভিন্ন বাস্তবতার কারণে তারা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতে পারে না। নলকূপ থাকলেও রান্নার কাজে পুকুরের পানি ব্যবহার করে। একই পানিতে তারা গোসল, গো-গোসল, গরুর জন্য ঘাস পরিস্কার, নানা ধরণের ধোয়াধুয়ি ইত্যাদি করে থাকে। খুব কম বাড়িতেই স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট দেখা যায়। অধিকাংশ মানুষ জঙ্গল বা খালে-বিলে মলত্যাগ করে থাকে এবং শিশুরা যেখানে সেখানে মলত্যাগ করে। মলত্যাগের পর খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, তারা সাবান বা ছাই ব্যবহার করে। বাড়ির আশেপাশের জঙ্গল থাকে অপরিচ্ছন্ন। ফলে মশামাছির উপদ্রব চোখে পড়ে। তারা স্বাস্থ্য সম্পর্কে মোটেও চিন্তিত নয়। বরং রোগব্যাধিকে জীবনের একটি অনিবার্য অংশ মনে করে।
প্রধান প্রধান রোগব্যাধি ও স্বাস্থ্য সমস্যাঃ
অশিক্ষা, দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যবিষয়ে অসচেতনতা ইত্যাদি কারণে গ্রামের লোকদের মাঝে রোগব্যাথি লেগেই থাকে। গ্রামবাসীও রোগব্যাধিকে ততোটা গুরুত্ব দেয় না। এখানে সচরাচর যে সকল রোগব্যাধি ও স্বাস্থ্যসমস্যা দেখা দেয় সেগুলোর মধ্যে অপুষ্টি, কৃমি, সর্দিকাশি, আমাশয়, জ্বর, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, কফ, খাজলী-চুলকানি, বাত, দাদ, মেছতা, রাতকানা, অনিয়মিত ও অতিরিক্ত ঋতুস্রাব, গর্ভকালীন সমস্যা, যৌন সমস্যা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। প্রতিরোধমূলক টীকা গ্রহণে তাদের আগ্রহ নেই বা বিষয়টি তারা জানে না বললেই চলে। কিছু স্বাস্থ্যসমস্যা যেমন পুষ্টিহীনতা, জ্বর, সর্দিকাশি, গর্ভকালীন সমস্যাকে গ্রামবাসী কোন ধরনের রোগ রোগ মনে করে না। মেলোনী, আজিজ, সরকারও (১৯৮১) অনুরূপ একটি অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। সেখানে গর্ভাবস্থাকে ভাবা হয় শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ সমস্ত ক্ষেত্রে তারা খুব বেশী অসুবিধার সম্মুখীন না হলে চিকিৎসা ছাড়াই দিন কাটায়। অবস্থা সহ্যসীমা অতিক্রম করলে প্রথমত তারা হোম থেরাপি (Home Therapy) নেয় অর্থাৎ বয়স্কদের দারস্থ হয়। মা, দাদা, দাদির পরামর্শ নিয়ে বাড়ির আশেপাশের জঙ্গল থেকে লতাপাতা সংগ্রহ করে চিকিৎসা করে। এতে না সারলে কবিরাজের শরণাপন্ন হয়(আলাউদ্দীন,২০০৩)।
রোগব্যাধি ও স্বাস্থ্য সমস্যা একটি সার্বজনীন বিষয়। কেউ এটি থেকে দূরে থাকতে পারে না। ছোট বড় সকলেই রোগব্যাধিতে ভোগে। রোগব্যাধি কেবলই একটি শরীরবৃত্তীয় বিষয় নয়, এর সাথে পরিবেশ ও সংস্কৃতির যোগসূত্র রয়েছে। চিকিৎসা নৃবিজ্ঞান স্বাস্থ্যসমস্যার সরূপ উন্মোচনে তাই সংস্কৃতি ও পরিবেশকে পৃথক করে দেখে না। ইভান উলফারস (১৯৮৯) উল্লেখ করেন শ্রীলংকায় লোকায়ত এবং আধুনিক উভয় চিকিৎসা পদ্ধতি সহজলভ্য। তা সত্ত্বেও মানুষ চিকিৎসা নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো বিবেচনা করে তা হল সহজপ্রাপ্যতা, ব্যয়, চিকিৎসকের সুনাম, আত্মীয়স্বজনের পরামর্শ ইত্যাদি। গ্রামাঞ্চলে এ সকল বিষয়ের বিবেচনায় লোকজন স্থানীয় চিকিৎসার প্রতি বেশী ঝুঁকে থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর জরীপ অনুসারে এখনও বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭৫-৮০% লোক ঐতিহ্যবাহী গুল্ম লতা ও ভেষজ ওষুধের উপর নির্ভর করে। জরীপে আরো দেখা গেছে ৭০ ভাগ লোক আধুনিক চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত। এই ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা স্মরণাতীতকালে থেকেই পৃথিবীতে চলে আসছে। সাধারণত মুসলিম বিশ্বে “ইউনানানী” চিকিৎসা বেশি চর্চা করা হয় এবং সনাতন হিন্দু সমাজে আর্য়ুবেদিক চিকিৎসা পদ্ধতির চর্চা করা হয়।
আশার কথা হল যে, বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা সম্পর্কে নতুন করে ভাবা হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, প্রকৃতিতে বেশি মাত্রায় কীটনাশক ও বালাইনাশকের ব্যবহার বাস্তুতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে এতে করে বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছে। যার ফলে গাছপালা, লতা, গুল্ম কমে যাওয়ায় কবিরাজ, স্থানীয় চিকিৎসকদের ভূমিকা ও কমে যাচ্ছে।
যোগাযোগ বা মিথস্ক্রিয়ার সমস্যা:
সহজ সরল গ্রামবাসী শহরের শিক্ষিত ডাক্তার এর কাছে যেতে সংকোচ বোধ করে। কারণ ডাক্তারের সাথে তাদের আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দূরত্ব। এছাড়া ডাক্তারের ফি দিয়ে চিকিৎসা নেয়া তাদের অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। সরকারি হাসপাতাল গ্রাম হতে দূর বলে সেখানে যাওয়া হয়না। বিধায় তারা এলাকার চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হয়। সাধারণত গ্রামের সকল মানুষ লোকজ চিকিৎসা সম্পর্কে জ্ঞান রাখে। এমন কারো সাথে আমার কথা হয়নি যে কিনা কখনই লোকজ চিকিৎসা নেয়নি (আলাউদ্দীন,২০০৩)। তথ্য দাতাদের মধ্য দারিদ্ররাই এ চিকিৎসা বেশি নিয়ে থাকে।
রোগব্যধি সকলের হলেও মহিলারা তাদের রোগের কথা কম জানাতে চায়। এমনকি তাদের স্বামীর কাছ পর্যন্ত গোপন রাখে। ফলে চিকিৎসকের কাছে তাদের যাওয়া কম হয়ে থাকে। বাড়ীর বয়স্ক মহিলাদের পরামর্শ নিয়েই তারা রোগ সারাতে চেষ্টা করে। না সারলে, স্বামী বা পিতার সাথে চিকিৎসকের কাছে গেলেও সমস্যার কথা চিকিৎসকের কাছে বলতে পারে না। ছোট ছেলে মেয়েদের সমস্যাও পিতা বা বড় ভাই চিকিৎসকদের জানান। এ সকল ক্ষেত্রে চিকিৎসক কেবল পুরুষদের সাথেই সরাসরি কথা বলে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। বাকিদের ব্যাপারে অনুমান নির্ভর চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
গ্রামবাসী অনেকাংশেই নিজের চিকিৎসা নিজেরাই করতে চায়। কিন্তু নিজে সমর্থ না হলে শেষে কবিরাজদের এর শরণাপন্ন হয়। আর্থিক অনটনের কারণে তারা চিকিৎসক এর কাছে যেতে চায় না। কিন্তু রোগব্যাধি তাদেরকে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকদের দারস্ত করে। চিকিৎসা সেবা বা পরামর্শের জন্য তাদেরকে কিছু অর্থও দিতে হয়। আর্থিক লেনদেন রোগ এবং রোগীর অবস্থা অনুযায়ী হয়ে থাকে। কঠিন রোগও রোগী মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন হলে চিকিৎসক যে পরিমান অর্থ দাবী করেন গরীব ও সাধারণ রোগের জন্য ততোটা নেয়া হয়না। রোগী ও চিকিৎসক পূর্ব পরিচিত বলে বাকিতেই চিকিৎসা সম্পন্ন হয়। মোটকথা চিকিৎসক ও রোগীদের নিবিড় সম্পর্কের কারণে লোকজ চিকিৎসার ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনে কড়াকড়ি খুব একটা হয় না।
ঞযব ঝঃধঃঁং ড়ভ যবৎনধষ সবফরপরহবং রহ ইধহমষধফবংয
বাংলাদেশের গুল্ম, লতা, পাতার ব্যবহার এবং বিভিন্ন অসুখ-বিসুখে আয়ুর্বেদিক, ইউনানী ও অন্যান্য স্থানীয় চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক পূর্বে থেকে চর্চা করা হচ্ছে। অধিকাংশ গ্রামের মানুষ এখন এসব চিকিৎসার উপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশে অনেক কবিরাজ ও আর্য়ুবেদিক ডাক্তার রয়েছে। কিন্তু, মাত্র ৪৯৫৫ জন লোকের জন্য একজন স্নাতক ডাক্তার রয়েছে বাংলাদেশে।
(Bangladesh
Bureau of Statistics) Zuberi, M. I.: Indigenous Medicinal Plant Use,
Sustainability and Biodiversity: Learning from the Grameen Bank Experince.)
বাংলাদেশের এসব ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা ব্যবস্থায় দুই ধরণের লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত একটি শ্রেনী হলো যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষন প্রাপ্ত, আরেক শ্রেণী হলো যারা Informal Way -তে শিক্ষা লাভ করে। যেমন:
* যারা দীর্ঘদিন যাবৎ কোন বিষয়ে চিকিৎসা লাভ করে
* যেসব মহিলা যাদের অনেক সন্তান রয়েছে। যেমন: গ্রামের ধাত্রী।
* ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সদস্য।
এসব লোক যেভাবে ডিগ্রি অর্জন করে তাহল-
* উত্তরাধীকার সূত্রে
* গুরুর নিকট থেকে
* নিজের চেষ্টায়
গ্রাম বাংলায় যেসব চিকিৎসা পদ্ধতি সচরাচর দেখা যায় তাহল-
কবিরাজি চিকিৎসা
ফকিরের চিকিৎসা
মৌলভীদের তাবিজ ও পানি পড়া
ওঝাঁর ঝাড়ফুক
হাঁড়-ভাঙ্গা জোড়া লাগানো। ঐতিহ্যবাহী হাড় বিশেষজ্ঞ
বিষনাশক বিশেষজ্ঞ, সাপের বিষ, কুকুরের কামড় প্রভৃতির চিকিৎসা
সুবিধা
ক্স একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় থেকে প্রাপ্ত।
ক্স সাপ্তাহিক কিস্তির মাধ্যমে এটি পরিশোধ করা সম্ভব।
ক্স তারা যখন আয় করবে তখন পরিশোধ করবে। যেমন: ধান উঠলে চিকিৎসকের টাকা দেওয়া যায়।
ক্স রোগ নিরাময় না হলে; পরবর্তী চিকিৎসার সুবিধাও পাওয়া যায়।
ব্যবহারকারী, চর্চাকারী আর্থ-সামাজিক বৈশিষ্ট্য:
(Socio Economic Characteristics of the Users,
Practitioner)t
মুন্সিগঞ্জ, টাঙ্গাইল এবং মৌলভীবাজারের এগারোটি থানায়
Ethno-medicine
users গবেষণা করা হয়
রোগীরা সব ধরণের বয়সের হয়ে থাকে। কিন্তু, রোগীদের গড় বয়স ২৬-৩৫ বছরের মধ্যে। ধর্মীয় বিচারে, মোট গবেষিত জনগোষ্ঠীর ৮৮ শতাংশ মুসলিম, ৬ শতাংশ হিন্দু এবং বাকী ৬ শতাংশ অন্যান্য ধর্মের। এই ৬ শতাংশের সকলের মৌলভীবাজারের প্রান্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী। যাদের বিভিন্ন ধরণের বিনিময় যোগ্য ধর্মীয় মতাদর্শ রয়েছে। যাদেরকে স্বনামী
(Sanamhi) বলে। বেশিরভাগ পুরুষরা ব্যবসায়ী এবং ছাত্র। অন্যান্যরা কৃষি, রিকশা ও ভ্যান চালক। এছাড়াও কিছু ছিল বেকার। ব্যবহারকারীদের গড় আয় ৫০০০-৬০০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ আয় ১২,০০০ টাকা। যে সমস্ত পুরুষদের কোন আয় ছিল না তারা হয় বেকার নতুবা ছাত্র। কিন্তু, একটা বিষয় নিশ্চিত তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ছিল না।
অন্যদিকে এক চতুর্থাংশ নিরক্ষর। যাই হোক ৩৭.২% উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ছিল। একজন ছিল এম.এ পাশ। ৫২.৩% অবিবাহিত এবং বাকীরা বিবাহিত। নারী ব্যবহারকারী বেশিরভাগ বিবাহিত। ৯৩ শতাংশ নিরক্ষর এবং গৃহিনী।
(Hassan
S, 2003, Ethno-Medicine in Bangladesh)
লোক চিকিৎসকদের সামাজিক মর্যাদা:
গবেষণাধীন গ্রামের পাঁচ জন চিকিৎসকের মধ্যে দুইজন কবিরাজী চিকিৎসা ও বাকি তিনজন কবিরাজী ও এলোপ্যাথিক উভয় চিকিৎসার সাথে জড়িত। একজন ম্যাট্রিক পাস করেছেন বাকীরা অষ্টম/নবম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ছেন। তারা ১০/১৫ বৎসর ধরে চিকিৎসার সাথে জড়িত বলে একটু আকার ইঙ্গিতে ডায়াগনষ্টিক করতে পারেন। যুগ যুগ ধরে গ্রামে চর্চা হয় বলে তারা কবিরাজী চিকিৎসাকে রপ্ত করেছেন বেশি করে। তারা বিভিন্ন বই, সাময়িকী পড়ে নিজেদের পেশাগত জ্ঞানের চর্চাকে শাণিত রাখতে সচেষ্ট। গ্রামে যে সকল চিকিৎসক রয়েছেন তারা সকলেই মোটামুটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য, কবিরাজী পেশার সাথে বংশ পরম্পরায় জড়িত।
গ্রামবাসী তাদেরকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান করে। গ্রামের বিভিন্ন সালিশে তাদেরকে ডাকা হয়। চিকিৎসা ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে লোকজন পরামর্শ নেওয়ার জন্য তাদের শরণাপন্ন হয়। তাছাড়া খুব বেশী পড়াশুনা না করলেও গ্রামবাসীর কাছে তারা শিক্ষিতজন বলে পরিচিত। তারা এই চিকিসকদের কাছ থেকে দেশের নানান খোজখবর নিয়ে যাক। লোকজন তাদের সম্মানের চোখে দেখে এবং যে কোন বিষয়ে তাদের পরামর্শকে উত্তম বলে মনে করে। তাদের আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালো। তারা বিপদে আপদে গ্রামবাসীকে আর্থিক সহযোগিতা করে এবং ঋণ দিয়ে থাকেন।
লোকজ চিকিৎসাঃ অগ্রাধিকার কেন?
গ্রামে এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, পানিপড়া ও কবিরাজী চিকিৎসা প্রচলিত। এগুলোর মধ্যে কবিরাজী পদ্ধতি সবচেয়ে বেশী প্রচলিত। যারা গাছপালা, লতা পাতার মাধ্যমে চিকিৎসা করে থাকেন তাদের গ্রামবাসী কবিরাজ বলে থাকেন। গ্রামবাসী রোগব্যাধিতে প্রথমত নিজেরাই চিকিৎসা নিয়ে থাকে। সুস্থ না হলে তারা কবিরাজের শরণাপন্ন হয়। আগে প্রায় সকল রোগের ক্ষেত্রেই গ্রামের মানুষ কবিরাজ এর শরণাপন্ন হতেন কিন্তু বর্তমান বড় বড় রোগব্যাধি হলে তারা হাসপাতালে যান। বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলেও অধিকাংশ গ্রামবাসীই ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতি হিসাবে লোকজ চিকিৎসাই বেছে নেয়। কারণ তারা এ পদ্ধতিতে চিকিসা নিতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন। এর পেছনে অনেকগুলো যৌক্তিক কারণ রয়েছে। যেমন, এ পদ্ধতি তাদের সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে। যুগ যুগ ধরে তাদের পূর্ব পুরুষেরা এর মধ্য দিয়ে রোগব্যাধিমুক্ত জীবন যাপন করেছে। তাছাড়া অতি অল্প কিংবা কখনো কখনো বিনা খরচে এই সেবা মিলে বলেও গ্রামের মানুষ এই চিকিৎসার প্রতি আগ্রহী। এই চিকিৎসার পক্ষে মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও কাজ করে। যেমন, মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে, হযরত আদম (আ:) কে সৃষ্টির পর আল্লাহ প্রকৃতির গাছ পালা ইত্যাদির গুণাবলি তাকে জানিয়েছেন। আবার হযরত সোলায়মান (আ.) কে গাছপালা নিজ থেকেই ডেকে নিজেদের নামও ঔষধিগুণ জানাত। অপর দিকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে তাদের চারটি ধর্ম গ্রন্থের একটিতে (অথর্ব বেদে) মনীষীগণ তাদের অভিজ্ঞতা থেকে গাছপালার ঔষধি গুণাবলীর কথা উল্লেখ করেছেন। ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে এর একটি যোগসূত্র রয়েছে বলে সহজ সরল ও ধার্মিক গ্রামবাসী বলে মনে করে। এছাড়া বাড়ির আশে পাশে পাওয়া যায় বলে এ সকল উদ্ভিদের দ্রব্যগুণ সম্পর্কে গ্রামবাসী অবহিত। অতি সহজে নিজ থেকেই রোগ প্রতিকারে এগুলো ব্যবহার করতে পারে বলে ছোটবেলা থেকে এ চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি একটি বিশেষ ভালবাসা গড়ে উঠে। আরও একটি বিষয়, গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে যে, গাছ-গাছালি অত্যন্ত নির্ভেজাল এবং বহুবিধ গুণাবলী ছাড়াও এর কোন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। অপর দিকে বাজারে যে সকল ঔষুধ পাওয়া যায় সেগুলো নির্ভেজাল তো নয়ই; বরং দামী এবং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পন্ন।
গ্রামে লোকজ বা কবিরাজী চিকিৎসাকে অগ্রাধিকার বিবেচনা করার যে কারণগুলো উপরে বর্ণিত হল তাকে একটু সুত্রায়িত করে দেখা যাক।
বিভিন্ন ধরণের মূল্যবোধ, বিশ্বাস, সংস্কারের কারণে তারা গাছপালা লতাপাতাকে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করে। আধুনিক চিকিৎসার অভাব ও অজ্ঞতার কারণেও মানুষ রোগব্যাধিতে লোকজ চিকিৎসা গ্রহণ করে।
সরকারী ডাক্তারের অপ্রতুলতা এবং ডাক্তারের সাথে মিথস্ক্রিয়ার সমস্যা গ্রামবাসীদেরকে হাসপাতালের আধুনিক চিকিৎসা থেকে সরিয়ে রাখে। দারিদ্র এবং রাহা খরচের আশঙ্কাও আধুনিক চিকিৎসা থেকে সরে থাকার একটি কারণ।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে গ্রামবাসী লোকায়ত জ্ঞানকে বেশি মূল্য দেয়। লোকজ চিকিৎসার উপাদানগুলো তার বিবেচনায় পরিবেশ থেকেই গৃহীত। তাই গ্রামের লোকজন চিকিৎসার ক্ষেত্রে লোকজ প্রণালীর কাছে বেশী আশ্বস্ত বোধ করে।
উপসংহার ও পরামর্শ:
বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তাদের আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারে না। বিকল্প হিসেবে লোক চিকিৎসা গ্রহণ করে। যাই হোক বর্তমানে ডাক্তার এবং রোগীদের কাছে লোকজ ঔষধের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজে বিভিন্ন ধরণের শিক্ষার প্রচলন বাড়ছে। উদাহরণ: বর্তমানে সকল সরকারি হাসপাতালে একজন করে আর্য়ুবেদী চিকিৎসক নিয়োগ করা হচ্ছে। অন্যদিকে বেশিরভাগ রোগীরা এ্যালোপ্যাথিক ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। পাশাপাশি এ্যালোপ্যাথিক ঔষধ অনেক ব্যয়বহুল। মানুষ এমন একটি বিকল্প খুঁজছে যা তাদের সীমার মধ্যে এবং কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। (মুহাম্মদ আলাউদ্দীন, লোকজ চিকিৎসা ঃ একটি নৃবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা )
উৎস সমূহঃ
মুহাম্মদ আলাউদ্দীন, লোকজ চিকিৎসা ঃ একটি নৃবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা, তৃণমূল উদ্যোগ: ৪র্থ বর্ষ, ১ম সংখ্যা, পৃষ্ঠা: ১০৯-১১৫, জুলাই ২০০৩।
Bangladesh.
Right: A Journal for Development and Research Activists. Published by National
Policy Advocacy Cell, Samata, Vol. No.4, September 2003.
Rural People. in Indigenous Knowledge Development In Bangladesh- Present and
Future edited by Paul Sillitoe, The University Press Limited, 2004.
Plant Use, Sustainability and Biodiversity: Learning from the Grameen Bank
Experince. In Indigenous Knowledge
Development In Bangladesh- Present and Future edited by Paul Sillitoe, The
University Press Limited, 2004.