কৃষক পেনশন এখন শুধু সময়ের দাবি

বয়স্ক বা প্রবীণ কৃষকদের তাদের দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অবদানের স্বীকৃতি এবং পেনশন এর দাবি নিয়ে সম্প্রতি মানিকগঞ্জের প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে হয়ে গেল মত বিনিময় সভা। মত বিনিময় সভায় মানিকগঞ্জ জেলার ৬টি উপজেলার সাধারণ কৃষক-কৃষাণী এবং বিভিন্ন কৃষক সমিতির সদস্য এবং নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সভার শুরুতে বারসিক পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বারসিক মানিকগঞ্জ রিসোর্স সেন্টারের আঞ্চলিক সমন্বয়কারি বিমল রায়। তার বক্তব্যে এই দাবির প্রেক্ষাপট এবং যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদনে সম্পূর্ণ অবদান সরাসরি কৃষকের। কিন্তু কৃষক তার উপাদিত পন্যের ন্যায্য দাম পায় না। সে সবসময় বঞ্চিত হয়, কৃষি পেশাকে মর্যাদা দেবার ক্ষেত্রে আমাদের সরকারি-বেসরকারী পর্যায়ে অনেক সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। একজন কৃষককে চাকুরির জন্য অন্যের কাছে যেতে হয়। তার নিজের কর্মসংস্থান এবং আরো অনেকের কর্মসংস্থান করে।
কর্মক্ষমতা হারানোর ফলে কৃষি উপাদক কৃষকেরই খাদ্যাভাব শুরু হয়। তাকে খাদ্যের জন্য অন্যের দ্বারস্থ হতে হয়। স্বয়ং কৃষকই তার খাদ্যের স্বাধীনতা হারান। খাদ্য উপাদকই যখন খাদ্য প্রাপ্তিতে শংকাগ্রস্ত হন; তখন নতুন নতুন খাদ্য উপাদক তৈরিতে বাঁধাগ্রস্ত হয়। কৃষক কৃষি কাজের প্রতি আগ্রহ হারান। নতুন নতুন কৃষক তৈরি না হয়ে কৃষক সন্তান বিকল্প কর্মসংস্থানে চলে যেতে থাকে। কৃষি ব্যবস্থায় এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করে। বাণিজ্যিক কৃষিতে মানুষ ধাবিত হয়। ফলে কৃষিতে আর কৃষকের নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। পুরো ব্যবস্থায় একজন কৃষক ক্রমাগত কৃষি থেকে দূরে চলে যাচ্ছে এবং একই সাথে বঞ্চিত হচ্ছে সকল ক্ষেত্র থেকে।
মানিকগঞ্জ এর কৃষক সমাজের পক্ষ হতে আমাদের আহবান বাংলাদেশের খাদ্য উপাদনে যে কোন প্রতিকুলতার মধ্যেও কৃষকের সক্রিয় ভূমিকা থাকায় প্রবীণ কৃষকের খাদ্য ও চিকিসা নিরাপত্তার লক্ষ্যে তার প্রবীণ অবস্থায় রাষ্ট্রকর্তৃক স্বীকৃতি হিসেবে ‘কৃষক পেনশন’ চালু করা অতি জরুরি’।
আলোচক এর বক্তব্যে বারসিক এর নির্বাহী পরিচালক সুকান্ত সেন জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষকের অবদান থাকা স্বত্বেও কীভাবে প্রতি পদে পদে প্রতারিত হচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে সে বিষয়ে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, “সরকার যেমন কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়, ঠিক তেমনি একজন কৃষকও ভর্তুকি দেন।” তিনি বলেন, “একজন কৃষক তার ফসলের উপাদন মুল্য এবং বিক্রয়মুল্যের ক্ষেত্রে প্রতিমণে প্রায় ২০০ টাকা ভর্তুকি দেয়। সে হিসেবে রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি ভর্তুকি দেন একজন কৃষক। কিন্তু তার এই অবদানের যেমন কোন প্রতিদান দান দূরে থাক স্বীকৃতিও নেই!
অন্যদিকে বাণিজ্যিক কৃষির ফলে কৃষক প্রতিদিন প্রতারিত হচ্ছে। উদাহরণ হিসবে তিনি বলেন, “একজন কৃষক উপাদন করেন ২৮ জাতের ধান। এই চালের বাজারমূল্য ২৫-৩৫ টাকা। কিন্তু এই চালই মধ্যস্বত্ব ভোগীরা মেশিনে কেটে মিনিকেট নাম দিয়ে বিক্রি করছে; আর জার বাজার মূল্য ৪০-৫০ টাকা। কিন্তু এরা কোনভাবেই উপাদক নয়; কিন্তুই তারাই লাভবান হচ্ছে। একই সাথে প্রতারিত হচ্ছে তাদের উপাদিত ২৮ ধানের নাম থাকছে না হয়ে যাচ্ছে মিনিকেট। আমরা ভোক্তা শ্রেণীও হচ্ছি প্রতারিত।
সুকান্ত সেন তাঁর আলোচনায় বলেন, নতুন প্রজন্ম যেমন কৃষক হিসেবে পেশাকে বেছে নিচ্ছে না; তেমনি বয়স্ক কৃষকরা বাধ্য হচ্ছেন দীর্ঘ দিন ধরে কৃষি কাজকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ২০ বছর আগে যেখানে কৃষকদের গড় বয়স ছিল ৬০ থেকে ৬৩ বছর। বর্তমানে এখন সেটি ৭৫-এ গিয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবীণ হিসেবে একদিকে যেমন রয়েছে বার্ধ্যকের শারীরিক-মানসিক কষ্ট। সেখানে আবার বাড়তি খাদ্যের চাহিদা চাপিয়ে দিচ্ছি। আমাদের খাবারের নিশ্চয়তা চাপিয়ে দিচ্ছি এই সমস্ত প্রবীণ কৃষকদের। তিনি বলেন, “তাই এই কৃষকদের জন্য কৃষক পেনশন এখন সময়ের দাবি। সরকার যে প্রবীণ ভাতা দেয় সেটা যেমন সকল কৃষক পায় না। ঠিক তেমনি সেটি যথেষ্টও নয়। প্রবীণদের এক মাসের ওষুধের খরচই হয় না। তাই কৃষকদের স্বীকৃতির জন্য আমরা কৃষকদের পেনশনের দাবটাকে জাতীয়ভাবে উপস্থাপন করতে চাচ্ছি।”
অন্যদিকে এ্যডভোকেট আজহারুল ইসলাম আরজু বলেন, “কৃষকরাও যে তাদের উপাদিত শস্যে ভর্তুকি দেয় সেটি যেমন সরকার জানায় না। তেমনি কৃষকরা নিজেরাও জানে না। অন্যদিকে সরকার যে সমস্ত ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয় সেটি সরাসরি কৃষকের কাজে আসে না। সরকার ভর্তুকি দেয় সার, বিষ, তেল এবং ট্রাক্টরে। এগুলো তো কৃষকের লাভবান করে বরং গ্রামে এক ধরণের ব্যবসায়ীদের সৃষ্টি করছে। গ্রামে গ্রামে কলের লাঙলের ব্যবসায়ী, পানি, বীজ, বিষ, তেল সব কিছুর ব্যবসয়ী আছে। কৃষকদের এই সব কিছু এই সমস্ত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনতে হয়। আমরা দাবি করছি না যে সব কৃষককে একসাথে এই পেনশন দিতে হবে। কিন্তু সীমিত আকারে হলেও শুরু করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।”
তিনি বলেন, “এই দাবির জন্য একটি সার্বজনীন কমিটি করতে হবে-আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য। প্রথমে জেলা পর্যায়ে এই ধরনের দাবি তুলে ঢাকা পর্যায়ে একটি কনভেনশন করতে হবে। জাতীয়ভাবে একটি আন্দোলন কমিটি করতে হবে। কৃষক পেনশন এখন শুধু সময়ের দাবি।” মানিকগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব চক্রবর্তী বলেন, “কোন দাবিই অযৌক্তিক নয়। এখনকার সবকিছুই আন্দোলন সংগ্রামের ফল। অনেকেই বলতে পারেন-কৃষকদের জন্য আবার পেনশন কেন? একসময় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা প্রভৃতি ছিল হাস্যকর। কিন্তু এখন তো সব স্বাভাবিক। একসময় কৃষকদের পেনশনও স্বাভাবিক হিসেবে মনে হবে। সাংবাদিক হিসেবে এই দাবির সাথে একাত্মতা জানাচ্ছি।
কৃষক নেতা সেতোয়ার হোসেন বলেন, “পাফাটা মেহনতি কৃষকের কিছু নেই। আমরা কৃষকরা বিপদে পড়েছি। কৃষক পেনশন অত্যন্ত জরুরি। সরকার কি করবে জানি না। তবে আমাদের এই অধিকার আদায়ের জন্য জোট বাঁধতে হবে।
রাষ্ট্রপতি পদক প্রাপ্ত প্রবীণ কৃষক শরীফ আলী বলেন, “মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি সার, বীজ, কীটনাশকসহ সবকিছুতে দখল করে আমাদের পরনির্ভরশীল করে তুলছে। কাঠের লাঙলের জায়গা দখল করেছে ইঞ্জিন লাঙ্গল। কৃষি ক্ষেত্রে নেই কোন ব্যবস্থাপনা। আমরা যারা কৃষক তারা আজ হযবরল অবস্থাতে আছি। ৬০ বছর পরে আমাদের যখন কর্মসংস্থান থাকবে না-তখন আমদের কি হবে? তাই কৃষক পেনশন প্রথা অবশ্যই চালু হওয়া দরকার।
কৃষক নেতা দুলাল বলেন, “কৃষক পেনশন এর দাবি কিছুটা ব্যতিক্রম লাগলেও; এটি এখন সময়ের দাবি। সারা দেশে নিয়মিত ও অনিয়মিত কৃষক আছে প্রায় ৬ কোটি। বিপরীতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে মাত্র ১২ লাখ। ৬ কোটি মানুষের স্বার্থ বিবেচনা না করে সরকার ১২ লাখকে বড় করে দেখছে। কৃষকের পেনশনের জন্য বাজেটে কৃষি ক্ষেত্রে বেশি বরাদ্দ করতে হবে। কৃষকের পেনশন দাবিকে জোরদার করার জন্য হাট বাজার, গ্রাম সভায় প্রচারণা চালিয়ে আরো মানুষকে সচেতন করতে হবে।”
কৃষাণী সাফিয়া বেগম বলেন, “যখনই কোন সুবিধা আসে সেটি কেউ পায়, কেউ পায় না। সবাই যেন পায় সে বিষয়ে সরকারকে দেখতে হবে। সরকারের কাছেই একটাই দাবি কৃষকদের যেন মূল্যায়ন করে, দাম দেয়।”
কৃষক আব্দুস ছালাম বলেন, “গরিব বয়স্করা বয়স্ক ভাতা পায়। কিন্তু সকল কৃষক সেই ভাতার আওতায় আসে না। তাই কৃষকদের পেনশন আমাদের জন্য খুব জরুরি। একজন চাকরিজীবী ২০-৩০ বছর কাজ করলেই পেনশন পায়। কিন্তু আমরা ৪০-৫০ বছর ধরে এত কিছু করলাম। কিন্তু আমাদের (পেনশন) কই? আমরা সকল গ্রামের কৃষকরা যদি একসাথে কথা বলতে পারি তাহলে আমাদের এই দাবী সরকারের কাছে পৌঁছাতে পারবো।”
আলোচক মোসলেমউদ্দিন বলেন, “আমাদের সবকিছু আজকে না হয়ে কালকে হলেও চলে। কিন্তু খাদ্য না হলে চলে না। আর এই খাদ্য যারা যোগান দেয় সেই কৃষক একটা বয়সের পরে তার নিজেরই খাদ্য থাকে না। তাই প্রবীণ কৃষকদের জন্য আমরা কৃষক পেনশন দাবি করছি। আমরা আমাদের টাকা থেকেই আমাদের পেনশন দাবি করছি। আমরা প্রতিদিন জিনিস কিনে যে ভ্যাট ও ট্যাক্স দেই সেখান থেকে সঞ্চিত অর্থ থেকেই-কৃষক পেনশন চাচ্ছি।
কৃষক লীগ এর সদস্য সচিব জাগীর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ বলেন, বয়স্ক ভাতা আছে কিন্তু কৃষক হিসেবে আলাদা কোন ভাতা নেই। ৬০ বছরেই ভাতা দিতে হবে এমন কোন দাবি আমরা করছি না। ৬০ বছরে না দেন ৭০ বা ৭৫ দেন। পদক্ষেপটা ভালো, সফল হলেও আরো ভালো।

“পুরাতন জিসিন কি ডিম পাড়ে?”- আসুন বেঁচে দিই!

বছরখানিক আগে টেলিভিশন, ইউটিউব, ফেসবুক কিংবা পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন বেশ চোখে লেগেছিল, কানে বেজেছিল। আর সেটি হল বিক্রয় ডটকমের ‘পুরনো জিনিস কি আর ডিম পাড়ে? ছবি তুলুন, পোস্ট করুণ আর বেচে দিন’। একই সময়ে ভারতীয় টেলিভিশনগুলোতে একই ধরণের বিজ্ঞাপন ‘পুরনো জিনিস কে ধরে না রেখে বেচে দিন।’-OLX.COM এর। সত্যিই তো পুরনো জিনিস কি ডিম পাড়ে? সুতরাং তাকে বেচে দিন?
পুরনো জিনিসের কি ডিম পাড়া ছাড়া আর কোন মূল্য নেই? আপনার বাবার দেয়া জীবনের প্রথম ‘ঘড়ি’; হাতে দিতে পারেন না-ওল্ড ফ্যাশান বলে! কি আর করা বেচে দিন। আপনার বিয়ের প্রথম লাল টুকটুকে ৪০ বছরের পুরনো শাড়ী-কি আর কাজে লাগবে? বেঁচে দিন। আমার বাবার একটি ৩৭ বছরের পুরনো সাইকেল আছে-আমারই চালাতে বেশ কষ্ট হয়। তবু বাবা সাইকেলটা এখনো চালান। সাইকেলটা তার শ্বশুর তার বিয়ের সময় তাকে উপহার দিয়েছিলেন। সাইকেলটা তো আর নতুন সাইকেল দেবে না! বরং মেইনটেনেন্সের জন্য প্রতিনিয়ত খরচ হবে। আমার বাবা কি সেটা বেচে দেবে? বেঁচে থাকতে তো নয়ই।
পুরনো মূল্যবোধ, সংস্কার, ভালোবাসা, বিশ্বাস-আস্থা ধরে রেখে লাভ কি বেচে দিই। ছোট বেলা থেকে দেখে এসেছি, শুনে এসেছি, শিখে এসেছি এবং বেচে এসেছি পুরনো জিনিস। পুরনো ছেড়া-ফাটা, ভাঙ্গাচুরা জিনিস দিয়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে চকলেট, আইসক্রিম, পাঁপড় ভাজা কিংবা বিনিময়ে মা-চাচীরা নিয়েছে ঘরের প্রয়োজনীয় হাড়ি-পাতিল। এগুলোর কি কোন প্রভাব নেই আমাদের জীবনে? এর বিন্দুমাত্রা রেশ কি নেই আমাদের মগজে?
এগুলো দেখতে-দেখতে, শুনতে-শুনতে আর করতে করতে যখন আমাদের নিজেদের জীবনে কোন পুরাতন, বৃদ্ধ, জরাজীর্ণ ঘরের মানুষকে দেখি-যারা হয়তো আপনার আমার বাবা-মা, দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানী যারা সারাদিন ঘরের কোনে বসে থাকে; ডিম পাড়ার জন্য। কিন্তু দিন শেষে কোন ডিমই পারে না। তখন কি বলতে ইচ্ছে করে না-ধুর এই বুড়া গুলো তো ঘরে বসে ডিমও পারে না; বেঁচে দিই বিক্রয় ডট কম কিংবা ওএলএক্স ডট কমের মতো কোন কম্পানি কিংবা ফেরিওয়ালার কাছে। জায়গাও বাঁচল, ঝামেলাও কমলো। সেই ফেরিওয়ালা হয়তো কোন ওল্ড এজড হোম কিংবা বৃদ্ধাশ্রম। কিংবা আমাদের বৃদ্ধ মানুষ বেচার মতো কোন কোম্পানি নেই বলে হয়তো ফেলে রাখি বাড়ির সবচেয়ে অন্ধকার ঘুপচি ঘরটিতে। কোন যত্ন নেই, আদর নেই, খোঁজ খবর নেই। পুরনো মানুষটার পিছনে যে অর্থ আর ওষুধ খরচ হয় সেটাও বুঝি বৃথা অপচয়।
ভাবছেন আমার কথার কোন ভিত্তি নেই। ভেবে দেখুন, আপনার বাসার পুরাতন দৈনিক পত্রিকাগুলো কি করেন ফেলে রাখেন সবচেয়ে অন্ধকারের ঘুপচিতে। তারপর যখন আর জায়গা হয় না তখন বেঁচে দেন কাগজওয়ালার কাছে। বাসার যত পুরাতন অব্যবহার্য, কাজে লাগে না এমন জিনিস আপনি কি বেঁচে দেন না একেবারে নামমাত্র মুল্যে? তাহলে ঠিক সেই একই আচরণ কি করেন না বাড়ির সবচেয়ে পুরাতন সদস্য-যিনি কোন কাজের না, বাসার জায়গার অপচয়। হয়তো সে আপনার আপনজন বলে বেচতে পারছেন না। কিংবা বেচার কোন সুযোগ নেই বলে হয়তো। জানি না যদি কোন দিন সুযোগ তৈরি হয়-তাহলে আমিও হয়তো বেচে দিতে পারি আমার পরিবারের পুরাতন সদস্যকে!
আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে বাসার পুরাতন জিনিস আর পুরাতন/বৃদ্ধ মানুষ কি এক? নিশ্চয় না। কিন্তু এই যে পুরনো জিনিসের প্রতি আমাদের দীর্ঘ দিনের আচরণ, অভিব্যক্তি, ব্যাখ্যা কি কোন প্রভাব ফেলে না আমাদের মানুষের সাথে আচরণ কিংবা দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে? বা আমাদের মনস্তত্ত্বে? যদি আপনার উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়। তাহলে অবশ্যই সেটা মারাত্মক।
দ্বিতীয় আর একটি প্রশ্ন মাথায় আসতে পারে। এই পুরনো জিনিসগুলো নিয়ে আমরা কি করবো? কোন কাজে লাগে না আবার অনেকখানি জায়গা নষ্ট হয়। বেচে দিলেই তো ভালো। একবারও কি ভেবেছেন আপনার এই পুরাতন, অকাজের জিনিসগুলো যারা নামমাত্র মুল্য দিয়ে কিনে নেয়- তারা কি করে? তারা কি আপনার মতো ফেলে রাখে? কক্ষনো নয়। সেটাকে কাজে লাগায়, ব্যবহার করে। কক্ষনো একটু মেরামত করে কিংবা একবারে রিসাইকেলিং করে ভিন্ন কিছু তৈরি করে ব্যবহার করে। কিন্তু আপনি কি কক্ষনো আপনার পুরাতন জিনিসটাকে রিসাইকেলিং করে ব্যবহার করার কথা ভেবেছেন? কিংবা আপনার সন্তানককে কি শিখিয়েছেন? যদি উত্তর ‘না’ হয় তাহলে-সে কীভাবে শিখবে যে পুরাতন জিনিসেরও মূল্য আছে। পুরাতন জিনিসের যেমন মূল্য আছে তেমনি মূল্য আছে আপনার পরিবারের সবচেয়ে পুরাতন সদস্যেরও। তার অভিজ্ঞতা, জ্ঞান এবং দেখাশুনার অশেষ মূল্য আছে আপনার এবং আপনার পরিবারে।
আপনার পরিবারের সকলেই ব্যস্ত। পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্যকে সময় দেয়ার কেউ নেই। আপনার পরিবারের প্রবীণ সদস্য হতে পারে সবচয়ে কার্যকরী। আপনার বাসায় কাজের লোক আছে কিন্তু আপনার স্কুল পড়ুয়া ছোট সন্তানকে বাসায় রেখে যেতে পারছেন না। শুধু যদি একজন প্রবীণ সদস্য থাকে তাহলে এই জটিল সমস্যার সমাধান নিমিষেই হবে। আপনার ছোট কংক্রিটের বাসাটা সবুজ আর প্রাণে ভরে তুলতে পারেন প্রবীণ সদস্যটি। নাগরিক ব্যস্ততা আর সমস্যায় একবারে বিপর্যস্ত। একটুও শান্তি পাচ্ছেন না। কারোর সাথে শেয়ার করতে পারছেন না। আপনার প্রবীণ অভিজ্ঞ বাবা-মা, দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানি অথবা শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সাথে একটু সময় কাটান, মন খুলে গল্প করুন। জানি তিনি হয়তো আপনার সমস্যার সমাধান করে দেবেন না। কিন্তু আমি নিশ্চিত আপনি কিছু অনুপ্রেরণা আর সাহস পাবেন। নতুন আত্মবিশ্বাসে ভরে উঠবেন। হয়ে উঠবেন এক নতুন আপনি।
একটু ভাবুন বাড়ির পুরাতন জিনিসটার যেমন হয়ে উঠতে পারে মূল্যবান। ঠিক তেমনি আপনারা পরিবারের প্রবীণ সদস্যও কম মুল্যবান নয়। আপনিও যেমন বিষয়টা আমল করবেন। তেমন করে শেখান আপনার সন্তানকেও। নতুবা আমি আপনিও হয়ে যাবো প্রবীণ-পুরাতন এক বৃদ্ধ। তখন আপনার আমার সন্তান যেন আমাদেরকে পুরাতন ভেবে বেচে না দেয়-‘ডিম পাড়ি না বলে!’

“এ্যানিমেলস ইউনাইটেড” : মানুষের কর্তৃত্বের উপর প্রাণ – প্রকৃতির প্রতিরোধ

“কিছু অদ্ভুত চরিত্রের, কুৎসিত জীব, নগ্ন, লোমহীন, রক্ত পিপাসু, ভয়ঙ্কর পশু। যারা নিজেদেরকে মানুষ বলে থাকে।” মানুষকে এভাবে সজ্ঞায়ন করে ‘এ্যানিমেলস ইউনাইটেড (২০১০)’ আ্যনিমেশন চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্রটিতে আফ্রিকান এলাকার একটি জঙ্গল এর কিছু প্রাণী তাদের প্রাকৃতিক পানির ন্যায্য হিস্যা বুঝে নেয়ার জন্য সকল প্রাণীর সংঘবদ্ধ হওয়ার গল্প বলা হয়েছে হাস্যরসাত্মক উপস্থাপনের মাধ্যমে। এই এলাকার প্রাণীদের সাথে যুক্ত হয় কিছু জলবায়ু উদ্বাস্তু প্রাণী। যারা হাজারো পথ পাড়ি দিয়ে আসে আফ্রিকান এই জঙ্গলে প্রাণীদের জন্য স্বর্গ ভেবে। কিন্তু এখানে এসে তারা বুঝতে পারে আসলে পালানোর কোন উপায় নেই। সবখানেই পেীঁছে গেছে মানুষের অপরিকল্পিত হস্তক্ষেপ প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপর। তাই আর পালানো নয়; বরঞ্চ বুঝে নিতে হবে নিজেদের অধিকারটুকু। সেই অধিকার আদায়ে বিভিন্ন ধরনের প্রানীদের একাত্মতা হওয়ার গল্প ‘এ্যানিমেলস ইউনাইটেড (২০১০)’ চলচ্চিত্রটি।
21
আফ্রিকার কোন একটি এলাকা- তৃণভূমি। যেখানে বছরে একটি নির্দিস্ট মৌসুমে পানি আসে একটি নদী থেকে। ঐ একটি মৌসুমের পানিতেই তাদের সারা বছরের খাদ্য এবং পানির যোগান হয়। কিন্তু, এ বছর নির্দিস্ট সময় অতিবাহিত হলেও এখনো পানি আসেনি। প্রাণীরা কম বেশি পানির সংকটে ভুগছে। শুরু হয়ে গেছে ২ টি প্রাণী গ্রুপের মধ্যে পানি নিয়ে ঝগড়া- স্বল্প পরিমাণ পানির উৎস নিয়ে। এমন পরিস্থিতিতে প্রথমেই সিংহ এবং তার বন্ধু (বেঁজি) পানির উৎসের খোঁজে বের হয়। পথের মধ্যে তাদের সাথে দেখা হয়- শ্বেত মেরু ভাল্লুক, অস্ট্রেলিয়ান ক্যাঙ্গারু, প্রায় ৭৫০ বছর ধরে জীবিত কচ্ছপ দম্পতি, টর্কিশ চিকেন প্রভৃতি প্রাণীর সাথে। অবশেষে তারা পানির উৎসের সন্ধান পায়, কিন্তু সেটি পাথর দিয়ে আবদ্ধ। যেটিকে আমরা (মানুষ) বলি ড্যাম্প বা বাঁধ। যা করা হয়েছে একটি ইকোট্যুরিজম এর নামে। এই ইকোট্যুরিজমে আবার বসেছে ১৬৮ তম জলবায়ু সম্মেলন। এই পার্কটিতে বানর, হাঙ্গর, সহ অল্প কিছু (সংখ্যায় এবং প্রজাতিতে) বিভিন্ন প্রাণীকে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। যথারীতি সেখানে তারা বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয় এবং সবশেষে সিংহ আটকা পড়ে। অন্যরা ফিরে যায় খালি হাতে তাদের জঙ্গলে।
সেখানে পানির সংকট এখন চরমে। অবশেষে তারা সবাই একত্রিত হয় সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য যে পানির উৎস থেকে কীভাবে পানি পাবে। আর যদি পানি না পায় তাহলে তাদের অস্তিত্ত্ব সংকটের সম্মুখীন হবে। কেউ কেউ আরো অপেক্ষা করতে চায়। কেউ মানুষ নামে এমন ভয়ঙ্কর (!) প্রাণী আছে যে পানিকে আটকে রাখতে পারে- এটি বিশ্বাসই করতে চায় না। অবশেষে তারা অধিকাংশ একমত হয় সবাই মিলে গিয়ে ড্যাম্প বা বাঁধ ভেঙে পানি নিয়ে আসবে। পরদিন তারা সবাই একত্রে যায় এবং কিছুটা নাটকীয় এবং সিনেম্যাটিক উপায়ে বাঁধ ভেঙে পানির প্রবাহ তাদের জঙ্গলে নিয়ে আসতে সক্ষম হয় এবং তাদের মাঝে আবার স্বাভাবিক প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে। পরবর্তীতে পৃথিবীর সকল প্রাণী একত্রিত হয়ে বিভিন্ন প্রধান প্রাধান শহরে গিয়ে অবস্থান নেয় এবং মানুষের কার্যক্রম অবরোধ করে জানান দেয় তোমরা (মানুষ) যদি তোমাদের কর্মকান্ডে সচেতন এবং প্রাণী ও প্রকৃতি বান্ধব না হও- তবে আমরাও পারি সেটি প্রতিরোধ করতে।
সিনেমাটি আহমরি কিছু নয়। আইএমডিবি রেটিং মাত্র ৪.৯/১০। পরিচালক রেইনহার্ড ক্লস ও হগলার টেপ। কিন্তু সিনেমাটিতে একটি বড় ধরনের দর্শন এবং দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলা হয়েছে।
আমাদের উন্নয়ন কর্মকান্ডের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আমাদের প্রকৃতি এবং প্রকৃতিক সম্পদ। কিন্তু উন্নয়নের নামে (কখনো সেটিতে ‘ইকো’ শব্দ যোগ করে) যত ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করছি সেটি প্রাণী, উদ্ভিদ, অনুজীব, মাটি, পানি, বায়ু এবং আলোর উপর কি ধরনের প্রভাব পড়ছে বা পড়তে পারে সেটি কী আমরা বিবেচনায় রাখি? এটি যদি আমরা প্রতিবেশের অন্যান্য উপাদানের দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পারি তাহলে সেটি যেমন এই মানুষ প্রজাতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে ভাল ফলাফল বয়ে আনবে ঠিক তেমনি ভাল হবে প্রতিবেশের সকল উপাদানের জন্যও।
22
মানুষ বলে, তারা নাকি সৃষ্টির সেরা জীব, তাদের ক্ষমতা অসীম। তারা প্রকৃতির সকল বস্তুকে নিজের করায়ত্ত্বে করে নিজেকে সাংস্কৃতিক জীব হিসেবে রূপান্তর ঘটিয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র অনুজীব এর ক্ষমতা সম্পর্কে কী আদৌ অবগত আছে? শুধু চিন্তা করুন, যে সমস্ত ব্যকটেরিয়া আমাদের চারপাশের জৈব যৌগকে পঁচন ঘটায়। সে সমস্ত অনুজীব যদি নিজেদের কাজটুকু বন্ধ করে দেয়; কিংবা মনে করুন তারা অভিযোজন করে তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে অন্য কিছুতে (পঁচানো বাদে) রুপান্তর করলো। ভাবুন একদিনেই আমাদের সভ্য পৃথিবী বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে।
আমরা মাঝে মাঝে কিছু মানুষকে তাদের কর্মকান্ডের কারনে বিভিন্ন পশু’র (প্রাণী) নামে কিংবা পশু হিসেবে সম্বোধন করি। কখনো ভেবেছেন কি- সেই মানুষই অন্য প্রাণীর কাছে হয়ে ওঠে- “কিছু অদ্ভুত চরিত্রের, কুৎসিত জীব, নগ্ন, লোমহীন, রক্ত পিপাসু, ভয়ঙ্কর পশু। যারা নিজেদেরকে মানুষ বলে থাকে।”
(ছবিগুলো ইন্টারনেট ওপেন সোর্স থেকে সংগৃহীত)

সহিষ্ণুতা : শৈশবেই শিখতে হবে প্রাণ ও প্রকৃতি থেকে

বর্তমান সময় এক অস্থির সময়। কিংবা সব সময়ই চলমান সময়টা হয়তো অস্থির থাকে। আমরা হয়তো সময়ের সাথে অনেক বেশি গতিশীল হয়ে যাচ্ছি। সাথে সাথে আমাদের আবেগ-অনুভুতিগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে-ধৈর্য্য, ভালোবাসা। হয়ে উঠছি অসহিষ্ণু। হত্যা, নির্যাতন, নৃসংসতা, আত্মহনন, ধর্ষণ আমাদের গতিশীল সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অনুসঙ্গ। আমরা হয়ে পড়ছি সহিংস। এই সহিংসতা শুধু মানুষে মানুষে নয়। ছড়িয়ে পড়ছে-প্রাণ এবং প্রকৃতির প্রতিও। কিংবা হয়তো প্রাণ-প্রকৃতি থেকে মানুষে। যেভাবেই ছড়িয়ে পড়–ক; সেটি ক্ষতিকর মানুষ এবং প্রাণ-প্রকৃতি উভয়ের জন্যই।

প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কেন সহিংস হচ্ছি বা সহিংস হয়ে পড়ছি? কিংবা কিভাবে আমাদের মধ্যে এই আচরণ তৈরি হচ্ছে? মনোবিজ্ঞান কিংবা আচরণ বিজ্ঞান হয়তো এর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারবে।

এ বিষয়ে আমার নিজের একটি ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যাটা আপনি মানতেও পারেন আবার নাও মানতে পারেন। কিন্তু ব্যাখ্যাটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে।
তবে এর আগে আলোচনা করা জরুরি আমরা প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি কী কী ধরনের সহিংসতা করি?
খুব ছোটবেলা থেকে আমার বদঅভ্যাস হচ্ছে গাছ দেখলেই কোন কারণ ছাড়া তার পাতা ছেড়া। আর হাতে যদি লাঠি থাকে তাহলে তো কথাই নেই! লাঠি নিয়ে আমি রাস্তার পাশের ছোট-ছোট গাছগুলোকে মেরে মেরে ন্যাড়া করে ফেলতাম। কিংবা ছোট খেঁজুর বা নারকেল গাছের পাতাকে ধরে মাঝখান দিয়ে ছিড়ে ফেলতাম। আমি শৈশবে প্রায়ই লাল পিপড়া কিংবা বড় কালো পিপড়া (মাজালি) দেখলে এর মাঝখান কেটে দু’টুকরো করতাম, দেখতে চেষ্টা করতাম পিপড়াটা পিছনের অংশ দিয়ে চলতে পারছে কিনা? অথবা আমি প্রায়ই টিকটিকি’র লেজ লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে ভেঙে দিতাম। আনন্দ নিয়ে উপভোগ করতাম এবং দেখতে চাইতাম লেজটা কতক্ষণ ছটফট করে। এছাড়া লেজকাটা টিকটিকিটা কীভাবে বেঁচে থাকে তা দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করতাম। আমি বলতে গেলে প্রতিদিন শুক্রবারে দলবেঁধে গিরগিটি মেরে সওয়াব অর্জন করার চেষ্টা করতাম! ব্যাঙ ধরে ইনজেকশন দিয়ে পানি পুশ করে দেখতাম ব্যাঙটার ভেতরে কতবেশি পানি ঢুকানো যায় এবং ব্যাংকটা পানিভরা পেটে কতদিন বেঁচে থাকে তা দেখতাম।
ছোটবেলায় আমি খেলার সাথী’র সাথে তুমুল ঝগড়া করতাম! রাতের অন্ধকারে ওর লাগানো ফুল গাছগুলো কেটে ফেলে দিতাম।  আমার তখনকার বিবেচনায় পাশের বাড়ির বুড়াটা (!) বেশ কৃপণ এবং একটা খাট্টাস বলে বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করে বুড়ার গাছের নারকেল, খেঁজুর রস কিংবা মুরগি ধরে সাবাড় করতাম। যতটুকু না খাওয়া- তার চেয়ে বেশি নষ্ট করতাম।
ছোটবেলার এই ছোট-খাটো (!) ছেলোমানুষি অপরাধগুলো আমরা সবাই খুব সাধারণভাবে নিই। এই অপরাধগুলোকে অভিভাবকগণ দুষ্টমি হিসেবে বিবেচনা করে একটু বকা-ঝকা করে আমাদের ছেড়ে দিতেন। আমরাও অপরাধ করেও পাড় পেতাম। নতুন আপরাধ করার জন্য প্রস্তুতি নিতাম। আমরা ধরেই নিতাম আমরা যা করেছি সেগুলো অপরাধ নয়; দুষ্টুমি মাত্র! দুষ্টুমি করতে আমাদের ভালো লাগতো। কিন্তু, এই দুষ্টুমি বা ঘটনাগুলোই আমার মতো প্রতিটি মানুষের মনে একটি গভীর রেখাপাত তৈরি করে। যেহেতু এসব ছোটখাট (!) অপরাধকে দুষ্টুমি হিসেবে ভাবতাম তাই আমরা শিখতে থাকি  ‘যে আমার চেয়ে আপাত দূর্বল; তাকে সহজেই ক্ষতি করা যায়। মেরে ফেলা যায়। কিছু না হোক বিরক্ত করা যায়।’ বিড়াল দেখলেই ফুটবলের মতো লাথি দেই, কুকুর দেখলে ঢিল ছুড়ি অকারণে- এগুলো আমরা তো নিয়মিত চর্চাই করতাম।
2-2
এভাবে আস্তে আস্তে এই সহিংসতা উদ্ভিদ এবং প্রাণী থেকে রূপান্তরিত হয় মানুষে। তাই আমরা ধরেই নিই যে, ছোট বোনটার চুল টেনে দেয়াটা অপরাধ নয় কিংবা দূর্বল বন্ধু কিংবা ছোটদেরকে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট দেয়া কোন ব্যাপারই না! অন্যদের সাথে অকারণে মারামারি, ঝগড়া এগুলোও হয়ে ওঠে অনুসঙ্গ।
পরবর্তীতে বড় হওয়ার সাথে সাথে এই আচরণগুলো বড় হতে থাকে। বোনের উপর অত্যাচার রূপান্তুরিত হয় বউ কিংবা রাস্তায় হেটে যাওয়া মেয়েটার ক্ষেত্রে- নারী নির্যাতন বা অধুনা ‘ইভটিজিং’। ছোট-খাটো চুরি রূপান্তরিত হয় চাঁদাবাজি কিংবা ছিনতাই এ।
ছোটবেলার এই সহিংস আচরণ আস্তে আস্তে বড় আকারের রূপ নেয়। মানুষ থেকে শুরু করে প্রাণ ও প্রকৃতির দিকে এই সহিংস আচরণ বিস্তার লাভ করে। তাই তো পারিবারিক ঝগড়াকে কেন্দ্র করে বাগানের নতুন লাগানো গাছগুলোকে কেটে ফেলতে আমাদের কষ্ট হয় না, বিবেকে বাঁধে না। কোন প্রতিবেশীর পুকুরের মাছ নিমিষেই বিষ দিয়ে মেরে ফেলতে আমাদের বুকটা কাঁপে না।কিংবা রাতের অন্ধকারে কারও অপরিণত ধান বা কলার বাগান নষ্ট করতে একটু অসস্তিবোধ হয় না আমাদের। অন্যদিকে মিছিল-মিটিং কিংবা রাস্তা অবরোধ করতে হবে- গাছে কেটে খুব সহজেই করা যায়।
খুব আপাত সাধারণ এই ঘটনাগুলো আমাদের সামাজিক মানুষের জীবনে দারুণভাবে প্রভাব পড়ছে। আমরা সভ্য (!), সাংস্কৃতিক (!) মানুষরাই হয়ে পড়ছি সহিংস, হিংস্র। বাড়ি, রাস্তা, অফিস, বাজার- প্রতিনিয়ত আমরা আমাদের অজান্তেই করছি সহিংস আচরণ।
বর্তমান এই সমস্ত সামাজিক ব্যাধি কিংবা আচরণগুলো প্রতিরোধ করতে হলে আমারে শুরু করতে হবে একেবারেই শৈশব থেকেই। পাশাপাশি, মানুষসহ সকল প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সহনশীল, শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞ আচরণ শেখাতে হবে নতুন প্রজন্মকে। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণ ও অস্তিত্ব  যে কষ্ট পেতে পারে এই ‘বোধ’ জাগ্রত করতে হবে সকলের মাঝে, বিশেষ করে শিশুদের মাঝে। তবেই সম্ভব সৌহার্দ্যময়, শান্তিপূর্ণ সমাজ এবং পৃথিবী গড়ে তোলা।
ছবি দু’টি  ইন্টারনেট এর উন্মুক্ত উৎস থেকে সংগৃহীত

একটি বীজ বিদ্যাপীঠ

‘নবধান্যিয়া’ শব্দের অর্থ হচ্ছে নয়টি শস্য বীজ। নব=৯ আর ধান্যিয়া= শস্যবীজ। এটি একটি জীব বৈচিত্র্য খামার (Bio-Diversity  Firm)। একই সাথে এটি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের-নাম ‘বীজ বিদ্যাপীঠ’ ইংরেজিতে বলা হয় ‘Earth University’। এই প্রতিষ্ঠানটির দাবি অনুযায়ী এটি একটি অর্গানিক বা জৈব কৃষি শিক্ষার আদর্শ স্থান।
প্রতিষ্ঠান এর নাম কেন নয়টি শস্য? এমন প্রশ্ন মাথায় আসা স্বাভাবিক। পরে জানলাম ‘নবধান্যিয়া’ এর শুরুর সময় প্রতিষ্ঠাতা ‘বন্দনা শিবা’ এই রামগড় গ্রামে দেশীয় বীজ সংগ্রহের জন্য বের হন। সারা দিন ঘুরে তিনি নয়টি শস্য বীজ সংগ্রহ করেন। তিনি লক্ষ্য করেন দেখেন ৯ সংখ্যাটি একটি টেকসই বা স্থায়িত্বশীল সংখ্যা। গণিতের সর্বোচ্চ অঙ্ক। তাছাড়া ৯ সংখ্যাটিকে যত বার গুন করা হোক না কেন সেখানে ৯ এর অস্তিত্ব থাকবেই। যেমনঃ ৭X৭=৪৯; এখানে যেমন ৯ আছে। তেমনি ৭X৯=৬৩; ৬+৩=৯। ‘নবধান্যিয়া’ এর লোগো হচ্ছে ইংরেজি ৯; যা আবার বীজ দিয়ে তৈরি। এখানকার অনেক কিছুই ‘নবধান্যিয়া’ লোগো এর সাথে মিল রেখে করা হয়েছে। ‘নবধান্যিয়া’ এর নামকরণ এর ঘটনা কাকতালীয় মনে হলেও তারা এই নামটাকে যৌক্তিক এবং অর্থবোধক করে তুলেছে।
Navadhanya-1
ভারতের উত্তরাখণ্ড প্রদেশের রাজধানী শহর দেরাদুন থেকে ১৬ কিমি দূরে রামগড় গ্রামে ৪৫ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রবেশের শুরুতেই পড়বে বিশাল আম বাগান। মনে হবে বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জের কোন আম বাগানে প্রবেশ করছি। ৫ মিনিট হাটার পরে চোখে পড়বে প্রবেশ দ্বার ‘বীজ বিদ্যাপীঠে স্বাগতম’।
প্রবেশের পর প্রথেমেই একটি লেখাতে চোখ আঁটকে গেল ‘Coke Pepsi Free Zone’. পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার বের হয়ে এসে স্বাগত জানালেন। এবং সহকর্মীর মাধ্যমে আমার রুম দেখিয়ে দিলেন। এটি কোন বড় বিল্ডিং নয়। ছোট ছোট একতলা ঘর। বাইরে থেকে প্লাস্টার বিহিন ইটের দেয়ালে লাল রঙ। কিন্তু ভিতরে প্রবেশের সাথে সাথে দ্বিধায় পরে গেলাম। কেননা ভেতর দেখে দেখে মনে হল মাটির দেয়াল। মাটি দিয়ে লেপা। পরে হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখলাম ইটের দেয়ালের ওপরে প্লাস্টার এবং রঙ না করে মাটি দিয়ে লেপানো। কিন্তু টয়লেট একবারে সুন্দর এবং আধুনিক।
guest house
যাইহোক, ফ্রেশ এবং অন্যান্য কাগুজে কাজ শেষে বের হলাম ‘নবধান্যিয়া জীব বৈচিত্র্য খামার/বীজ বিদ্যাপীঠ’ পরিদর্শনে। ম্যানেজার জে পি কালি পরিচয় করিয়ে দিলেন চন্দ্র শেখর ভাট এর সাথে। উনি কিছু ছেলে-মেয়েদের সাথে কাজ করছিলেন একটি মাঠে। ছেলে-মেয়েদের সাথে পরিচিত হয়ে জানতে পারলাম তারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছে এখানে ইন্টার্নশীপ করার জন্য। প্রথমে পরিচিত হলাম লিয়াট এর সাথে আমেরিকা থেকে ভারতে এসেছে ইন্টার্নশীপ করার জন্য। এটি তার গ্রাজুয়েশন এর একটি অংশ। তারপর শিবম; সবচেয়ে ছোট। দশম শ্রেণীতে অধ্যয়ন করে-দেরাদুনেই পড়ে। ওর গরমের ছুটিতে এসেছে এখানে এক মাসের জন্য। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি ‘নবধান্যিয়া’ থেকে এমন কোন একটি জিনিস শিখেছ যেটি তোমার সারাজীবনের জন্য কাজে লাগবে?’ ও বলল, ‘এখানে আসার পূর্বে আমি খুব দুষ্ট ছিলাম। কিন্তু, এখানে আসার পর আমি কেমন জানি বদলে গেছি।” গত সপ্তাহে রবিবারের ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখন আমাকে সবাই দেখে বলল, আমি নাকি ভালো হয়ে গেছি। এখানে এসে আমার কৃষির প্রতি আকর্ষণ জন্মেছে। আমি পড়াশুনা শেষ করে আমার বাবার সাথে কৃষি কাজ শুরু করবো’।
interns
এর পরে পতিতপাবন চৌধুরী ওহম; ওড়িশ্যা থেকে এসেছে। সে ওড়িশ্যার একটি কলেজ থেকে বিবিএ করছে শেষ বর্ষের ইন্টার্নশীপ এর অংশ হিসেবে বীজ বিদ্যাপীঠ এ এক মাসের জন্য এসেছে। ওর আগ্রহের জায়গা মানব সম্পদ। ওর কৃষি এবং কৃষকদের নিয়ে একটি ড্রিম প্রজেক্ট রয়েছে এবং সেটি অর্গানিক কৃষিকে কেন্দ্র করেই।
ওহম এর সাথে ওর বন্ধু ধিরাজ মিশ্রা। কলকাতার ছেলে হলেও ওড়িশ্যায় বেড়ে ওঠা। ওর আগ্রহের জায়গা অর্গানিক কৃষির মার্কেটিং নিয়ে।
এই ৪জন ইন্টার্নকে সমন্বয় করছেন মিস প্রীতি। উনি পিএইচডি করছেন। পাশাপাশি বীজ বিদ্যাপীঠ এ প্রতিবেশ গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। আমি বাংলাদেশ থেকে ৩ দিনের জন্য এই টিমের সাথে মিশে গিয়ে তাদের প্রতিদিনের কাজের সঙ্গী হলাম। এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলাপ হবে।
gazibo
চন্দ্র শেখর ভাট, আঞ্চলিক সমন্বয়কারী আমাকে নিয়ে পুরো খামার ঘুরিয়ে নিয়ে দেখাতে বের হলেন এবং পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন খামার অন্যান্য কর্মীদের সাথে।পুরো খামারটি ৪৫ একর। একটি বড় অংশ আম বাগান। আম বাগানের ভিতরে থাকার জন্য কুঠির; এছাড়া প্রশাসনিক কাজের জন্য কয়েকটি কুঠির এবং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় ডরমেটরি। সকালের মেডিটেশন, আড্ডা কিংবা অনানুষ্ঠানিক সভার জন্য রয়েছে খড়ের চালার গোলাকার ঘর। এই ঘরটির নাম গাজিবো। এটি সংস্কৃত এবং বুদ্ধ ধর্মের যৌথ সম্মিলন। শ্রদ্ধায় অবনত জ্ঞান কেন্দ্র। এখানে উন্মুক্ত জ্ঞান আহরণের সুযোগ তৈরি হয় বলে এমন নাম। গাজিবো নিয়ে মুগ্ধ হলাম যখন জানলাম- এটি তৈরি করা হয়েছে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ট্যাঙ্কের উপর। এর সাথে ডরমেটরির ছাঁদ এর সাথে সংযোগ রয়েছে। সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এর চেয়ে ভালো হতো বলে আমার জানা নেই। যখন পানির সংকট থাকে তখন এই বৃষ্টির পানি ব্যবহার করা হয়।  (চলবে…)

ভালোবাসা ছড়িয়ে যাক প্রাণ ও প্রকৃতিতে!

১৪ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। প্রতিবছর সারা পৃথিবীর মানুষ ভালোবাসা দিবস উদযাপন করে ব্যক্তিক কিংবা সামষ্টিকভাবে। বিশেষ করে বয়োঃসন্ধিকালীন ছেলেমেয়ে এবং আপত তরুণদের মাঝে এই দিনটির বিশেষত্ব লক্ষ্যণীয়। এটির ইতিহাস, সাংস্কৃতিক পরিচয় কিংবা উদযাপনের ধরণ এবং ঢং নিয়ে রয়েছে হাজারো আলোচনা ও সমালোচনা। তবে সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে-এই দিনটিতে সারা পৃথিবীতে এক ধরনের ‘পজিটিভ ভাইভ’ বিরাজ করে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এই পজিটিভ ভাইভটার খুব বেশি প্রয়োজন।
পৃথিবী তার সৃষ্টিলগ্নে ছিল উত্তপ্ত। তারপর ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকে। সেই শীতল অবস্থা থেকে এই সবুজ পৃথিবীর ‘সবুজ অধিবাসী’রাই পৃথিবীকে বাসযোগ্য উষ্ণ করে তুলেছে। সবুজ অধিবাসী বলতে পৃথিবীতে বিরাজমান লক্ষাধিক প্রাণকে বোঝানো হচ্ছে। তারা তাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অর্থাৎ জীবনধারণ এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে বাসযোগ্য উষ্ণ করে তুলেছে। আজকের এই সভ্য পৃথিবীর দাবিদার যতটুকু মানুষ! ঠিক ততটুকুই কিংবা তারও অধিক দাবিদার বাদ বাকি প্রাণ। কিন্তু মানুষ নামক দাম্ভিক (!) প্রাণী নিজেকে ‘ফোকাস’ করতে গিয়ে আর সকল প্রাণকে ‘ডি-ফোকাস’ করে ফেলেছে। তাই তো পৃথিবীকে উষ্ণ করতে গিয়ে ধীরে ধীরে বৈশ্বিক উষ্ণতার মতো সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা’র জন্য প্রাকৃতিক কারণ এর সাথে শুধু মানুষ্য সৃষ্ট কারণই জড়িত। অন্য কোন প্রাণ এর জন্য দায়ি নয়। কিন্তু এই বৈশ্বিক উষ্ণতার মতো সমস্যা সমাধানে মানুষের প্রয়োজন পৃথিবীতে বিদ্যমান সকল প্রাণীর সহযোগিতা।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বলতে শুধু প্রাকৃতিক উষ্ণতাই নয়। এর সাথে সাথে সমাজিক-সাংস্কৃতিক উষ্ণতাকেও বিবেচনা করা হচ্ছে। দিনকে দিন এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে সমান্তরালভাবে। যুদ্ধ, সন্ত্রাস, সামাজিক সহিংসতা, নির্যাতন, প্রতিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের মতো হাজোরো সমস্যায় জর্জরিত বর্তমান পৃথিবী এবং মানুষ। এই সমস্যার নেতিবাচক প্রভাব শুধু মানুষ একা ভোগ করছে না; অন্য প্রাণও সংকটের সম্মূখীন। কিন্তু একমাত্র মানুষই পারে এই সমস্যা থেকে উত্তোরণ করাতে। অন্য প্রাণ হতে পারে সহযোগী, সহযাত্রী; কিন্তু নেতৃত্ব মানুষকেই দিতে হবে।
ভালোবাসা দিবসে যে ‘পজিটিভ ভাইভ’ বিরাজ করে সেই পজিটিভ ভাইভটা হতে পারে এই বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের প্রাথমিক ধাপ। কিন্তু সেটি শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। আরো নির্দিষ্ট করে বললে শুধুই আমাদের ভালোবাসার মানুষ কিংবা সবচেয়ে নিকটজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সেটি কী এই স্বল্প গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে? আসুন এই গন্ডি থেকে বেরিয়ে আসি।
এই ভালোবাসা দিবসে ভালোবাসা বিলিয়ে দেই আমাদের সবচেয়ে দূরত্বের সম্পর্কের মানুষের জন্য। যে ব্যক্তিটির সাথে আমাদের সবচেয়ে খারাপ সম্পর্ক; আসুন এই ভালোবাসা দিবসে তাকেই ভালোবাসি। তাকে একটি ফোন দিয়ে জানাই ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা। ভালোবাসা দিবসে আমরা ফুল ও চকলেট উপহার দিতে ভালোবাসি। সেই ‘শত্রু’কেই দিই ফুল আর চকলেট। দেখবো আমাদের জীবনটা আরো বেশি ভালোবাসায় ভরে উঠবে।
ভালোবাসা দিবসে আমরা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ভালোবাসা বিলিয়ে দিতে চাই। চলুন না বিলিয়ে দিই যার সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা প্রয়োজন সেই মানুষটাকেই। হয়তো আপনার আমার পরিচিত কেউ মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত; তাকেই জানাই আমাদের ভালোবাসা। কিংবা আমাদের আশেপাশের হাজারো ভালোবাসা (!) বঞ্চিত মানুষ আছে- আসুন তাদেরকেই ভালোবাসি। ভালোবেসে ব্যবস্থা করি একবেলার খাবার- ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের পরিবর্তে। কিংবা প্রয়োজনীয় সেবা। আসুন ভালোবাসা দিবসে ছুটি নিয়ে-ভালোবাসার মানুষটিকে সঙ্গে নিয়ে সময় কাটাই কিছু ভালোবাসা বঞ্চিত নারী, শিশু এবং প্রবীণ নাগরিকের সাথে। ভালোবাসা দিবসে আসুন রক্ত দেই। কিংবা ব্যস্ত দিনের হাজারো ব্যস্ততার মাঝে একটি অন্তত ভালো কাজ করি।

ভালোবাসা কি শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? আমরা কী শুধু মানুষ নিয়েই বেঁচে থাকি? মানুষ ছাড়াও আমাদের চারপাশে হাজারো বস্তুগত এবং অবস্তুগত উপাদান রয়েছে। সেই সমস্ত উপাদানগুলোকে কি ভালোবাসা যায় না? আমরা যে বায়ু গ্রহণের মাধ্যমে বেঁচে আছি-সেই বায়ুকে চলুন ভালোবাসি। দূষিত বায়ুকে কম দূষিত করি (কম কার্বণ নিঃসরণ করা) কিংবা বিশুদ্ধ করার (গাছ লাগানো) উদ্যোগ নিয়ে বায়ুকে ভালোবাসি। আসুন মাটিকে ভালোবাসি; কম রাসায়নিক সার-কীটনাশক ব্যবহার কিংবা মাটি দূষণ কম করে।
ভালোবাসার অন্য এক প্রতিশব্দ হয়তো ফুল। আমরা প্রতিবার ভালোবাসা দিবসে ভালোবাসার মানুষটিকে ফুল উপহার দিই-খুবই ভালো কথা। এবার ফুলটিকেই ভালোবেসে একটি ফুলগাছ লাগাই। যেন আগামী ভালোবাসা দিবসে ফুল কেনা না লাগে। কিংবা ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষটিকেই হয়তো একটি ফুলগাছই উপহার দিলাম।
ভালোবাসা দিবসে অনেকেই মানবতার জন্য রক্তদান ক্যাম্প, চিকিৎসা ক্যাম্প, অর্থ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজন করি। নিঃসন্দেহে খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণীর জন্য স্বাস্থ্য ক্যাম্প কিংবা প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় অর্থ সংগ্রহ করতে কী পারি না-এই ভালোবাসা দিবসটিকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে। আসুন ভালোবাসা দিবসে কিছু না পারি প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের অন্তত ক্ষতি হয় এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকি।
কেন ভালোবাসার এই গন্ডি ভাঙা জরুরি? কারণ মানুষ একা বাঁচতে পারে না। আর তাই মানুষের প্রয়োজনেই মানুষের পাশাপাশি অন্য প্রাণ এবং প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিক্ষা দিক এই সার্বজনীন ভালোবাসা দিবস। এই দিনের ‘পজিটিভ ভাইভ’ একটি নির্দিষ্ট গন্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে আরো বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে দিতে পারলেই এই দিনটির প্রকৃত তাৎপর্য ফুটে উঠবে। পাশপাশি, শুধু মানুষে-মানুষে সীমাবদ্ধ থাকলে এক সময় মানুষ ছাড়া আমাদের চারপাশে আর কিছুই থাকবে না। আবার শুধু ভালোবাসার মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে আমাদের শত্রু সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। তাই ভালোবাসাতে হবে সবাইকে। আমাদের শত্রুকে; ভালোবাসা বঞ্চিত মানুষটিকেই। ভালোবাসতে হবে আমাদের চারপাশের প্রাণ, প্রকৃতি এবং প্রতিবেশকে। তবেই সম্ভব একটি ভালোবাসাময় পৃথিবীর। যেটি হবে আরো বেশি উপযোগী, স্বাচ্ছন্দ্য এবং  টেকসই সকল প্রাণের জন্য।

দ্বন্দ্ব ও উন্নয়ন (Conflict and Development)

উন্নয়নকর্মী হিসেবে একটা জিনিস বারবার ভাবিয়েছে। আমরা বারবার ‘না ঘর কা না ঘটকা’ অবস্থানে থাকি। এড়িয়ে চলি সকল ধরনের ঝামেলা  বা দ্বন্দ্ব। কিন্তু দ্বন্দ্ব ছাড়া যেখানে আমাদের জীবনের কোন কাজই সম্ভব নয়। সেখানে সমাজ পরিবর্তন বা উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব। খাদ্য গ্রহণ থেকে ত্যাগ, চলাফেরা, বিনোদন সব কিছুর সাথে দ্বন্দ্ব বা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিদ্যমান। সুতরাং উন্নয়ন বা সমাজ এর ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য যদি সমাজে বা প্রকৃতিতে বিদ্যমান অপরিহার্য দ্বান্দ্বিক সম্পর্ককে এড়িয়ে বা পাশ কাটিয়ে কী আদৌও সম্ভব!

দ্বন্দ এবং উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করার আগে দ্বন্দ্ব কে নিয়ে একটু নাড়াচড়া করা জরুরি। প্রথমেই জেনে নেই দ্বন্দ্ব এর সংজ্ঞা এবং ধরণ সমূহ।
Conflict শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয় ‘দ্বন্দ্ব’ শব্দটি। দ্বন্দ্ব বলতে বুঝায় সংঘাত, ঝগড়া, বিবাদ, যুদ্ধ বা শত্রুতা; দ্বিধা বা সংশয়। দ্বন্দ্ব হলো বৈপরীত্য বা Contradiction। দ্বন্দ্ব একটি সমাজ এবং সংস্কৃতিতে গতিশীলতা দান করে। সবকিছু নিয়ত গতিশীল, তা সে অণু-পরমাণুই হোক কিংবা গ্রহ-নক্ষত্র। আমরা আমাদের সীমিত খালি চোখে তা সবসময় অনুধাবন করি না। এবং এই গতিশীলতার মধ্যে বৈপরীত্য কাজ করে। আর এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই সবকিছুর বিকাশ হয়। সে জন্যই কোন কিছু বিকাশের কিংবা পরিবর্তনের পথ কখনো মসৃণ হয় না। ধীরে ধীরে জড়ো হওয়া ছোট ছোট পরিবর্তন হঠাৎ করে বড় পরিবর্তনের সূচনা করে।

দ্বন্দ্ব বলতে বোঝায় একটি দলের এক বা একাধিক সদস্যদের মধ্যে মতপার্থক্য, বিরোধ, সংঘর্ষ প্রভৃতি বিশ্বাস বা কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তবে দ্বন্দ্ব দু’টি দলের মধ্যেও হতে পারে। দ্বন্দ্ব যখন একই দলের মধ্যে সংঘঠিত হয় তখন তাকে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বলে। আর যদি দ্ইু বা ততোধিক দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয় তখন সেটিকে আন্তঃদলীয় দ্বন্দ্ব বলা হয়। দ্বন্দ্বকে দেখা হয় পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে। অর্থাৎ দ্বন্দ্ব কোন স্থায়ী ও অনড় নয়। যদি দ্বন্দ্ব সমঝোতায় আসে তাহলে দলের সদস্যরা পুনরায় আগের কাজগুলো করতে থাকে। সমঝোতা না হলে নতুন একটি বিষয় বা ঘটনার সূচনা হয়।
মানুষ এবং দ্বন্দ্ব (সামাজিক দ্বন্দ্ব)
মানুষের সৃষ্টি থেকেই দ্বন্দ্বের শুরু। কখনো সে নিজের সাথে। কখনো বা অন্যের সাথে। আমাদের চারপাশের প্রতিদিনকার ঘটনাগুলো লক্ষ্য করলে আমরা দ্বন্দ্বের নানারূপ দেখতে পাই। কিছু সাধারণ দ্বন্দে¦র রূপ হচ্ছে-গোত্র-গোত্র দ্বন্দ্ব, জাতিগোষ্ঠী দ্বন্দ্ব, নারী-পুরুষ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, মতাদৈর্শ্বিক দ্বন্দ্ব  (বামপন্থী বনাম ডানপন্থী), মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্ব (গার্মেন্টস কর্মী এবং মালিক)। কখনো কখনো এই দ্বন্দ্বের কারণ হয় বস্তুগত উপাদান নিয়ে। যেমন: প্রাকৃতিক সম্পদ ভূমি নিয়ে চরাঞ্চলগুলো প্রায়ই দ্বন্দ্ব লেগে থাকে। আবার সাংস্কৃতিক উপাদান নিয়েও দ্বন্দ্বের সংখ্যা কম নয়। উদাহরণ হিসেবে ভাষা নিয়ে দ্বন্দ্ব, সম্মান-প্রতিপত্তি নিয়ে, ধর্ম নিয়ে, প্রভৃতি।
দ্বন্দ্বের বৈচিত্রতা 
দ্বন্দ্বকে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়। ধারণা করা হয়, শুধুমাত্র মানুষে মানুষেই দ্বন্দ্ব হয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃতির প্রায় অধিকাংশ বিষয়ের সাথে দ্বন্দ্ব অপরিহার্য একটি বিষয়। মানুষে মানুষে যেমন দ্বন্দ্ব থাকে তেমনি দ্বন্দ্ব হয় মানুষ এবং প্রকৃতির সাথে। আবার প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের সাথে দ্বন্দ্বের প্রকৃতি এবং পদ্ধতি এক নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মানুষ এবং প্রাণীর মধ্যে যে ধরনের দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল, মানুষ এবং উদ্ভিদের সাথে ভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল। আবার ভৌত উপাদান মাটি, পানি, বায়ুর সাথে ভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। আমরা যদি বায়ুকে দূষিত করে ফেলি আমাদের বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে তাহলে একসময় ওই বায়ু আর আমাদের জীবন প্রদায়ী না হয়ে হুমকির কারণ হয়ে যায়। তখন আমরাই আবার নানাভাবে সেই বায়ুকে নিজেদের জীবন উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করি।


মানুষ ছাড়াও অন্যান্য জৈবিক এবং ভৌত পরিবেশের একটি উপাদানের সাথে অন্যটির নানা ধরনের দ্বন্দ্ব বিরাজ করে। আবার একটি প্রাণীর সাথে উদ্ভিদের যে দ্বন্দ্ব, সেটি উদ্ভিদে-উদ্ভিদে বা প্রাণীতে-প্রাণীতে ভিন্ন হয়। আবার একই উদ্ভিদ বা প্রাণীর মধ্যে প্রজাতি ভেদেও দ্বন্দ্ব বিদ্যমান থকতে পারে। সবশেষে পরিবেশের ভৌত বা জৈবিক উপাদানের সাথে জড় উপাদানের মধ্যেও দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল। আবার জড় বস্তুর মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল থাকতে পারে। যেমন: প্রযুক্তি হিসেবে লাঙল এর ব্যবহার কমে যায় যখন কৃষি ক্ষেত্রে পাওয়ার ট্রিলার এর আর্বিভাব হয়। অন্যদিকে জড় বস্তুর ব্যবহারের সাপেক্ষে পরিবেশের জৈবিক উপাদানের সাথে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তৈরি হয়। পাওয়ার ট্রিলার দিয়ে ভূমি কর্ষণের ফলে মাটিস্থ কেঁচোসহ অন্যান্য উপকারী কীট-পতঙ্গ নষ্ট হচ্ছে। আবার কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে বায়ু দূষণও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দ্বন্দ্ব এবং উন্নয়ন
দ্বন্দ্বকে যদি পরিবর্তনের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়। আর উন্নয়ন যদি আর্থ-সামাজিক নির্দেশকের ইতিবাচক পরিবর্তন হয়। তাহলে দ্বন্দ্ব উন্নয়নেরই একটি অংশ। আবার কোন একটি জনগোষ্ঠীর দ্বন্দ্বগুলো না বুঝতে পারলে সেই জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে। আর এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিবেচনা না করাই বুঝি কাংখিত উন্নয়নের পথে আমাদের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। ধরা যাক, কোন একটি প্রান্তিক এবং সুবিধা বঞ্চিত(!) একটি জনগোষ্ঠীর জন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হলো। কিন্তু, এখানে ওই জনগোষ্ঠীর সাথে আর যে সমস্ত জনগোষ্ঠীর দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক রয়েছে তারা উন্নয়ন পরিকল্পনার বাইরে থাকে। তাহলে প্রকল্পের কার্যক্রমগুলো কী আদৌও কার্যকর হবে?

অন্যদিকে উন্নয়নে যদি মানুষ-মানুষ ছাড়া প্রকৃতির অন্যান্য দ্বন্দ্ব গুলোকে বিবেচনা না করা হয়; তাহলে সেটি টেকসই উন্নয়ন হবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে বরেন্দ্র এলাকার খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করার জন্য ধান চাষভিত্তিক প্রযুক্তির অবতারণা এই প্রতিবেশীয় ধান এবং অন্যান্য প্রজাতি কিংবা পানি এবং মাটির যে সম্পর্ক সেটি ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করেছে। কিংবা ধান চাষ বৃদ্ধির ফলে ঐ এলাকার অচাষকৃত খাদ্য হিসেবে বিবেচিত উদ্ভিদ প্রজাতির ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়েছে-সেটিও বিবেচনা করা জরুরি। যদি এই বিষয়গুলো বিবেচনা না করা হয় তবে সেটি তাৎক্ষণিক সুফল বয়ে আনলেও দীর্ঘমেয়াদে নানা ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে।


উদাহরণ হিসেবে জেন্ডার উন্নয়ন বলতে এখনো পর্যন্ত প্রধানতম ধারণা হচ্ছে জেন্ডার মানেই নারী। যার সকল কিছুতে নারী সম্পৃক্ত থাকবে। অনেকটা এভাবে বলা যায়, নারীদের জন্য নারীদের দ্বারা পরিচালিত এবং বাস্তবায়িত উন্নয়ন কার্যক্রম। এখানে শুধু পুরুষরা বাইরে থাকে তাই নয়; অনেকাংশে পুরুষকে জেন্ডার সমতার পরিপন্থি বা অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু, অন্যান্য বিষয়ের  মতো নারী পুরুষের সম্পর্ক চিরকালই দ্বন্দ্বিক। তাই জেন্ডার সমতার ক্ষেত্রে নারী পুরুষ এর দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিবেচনা করাটা আত্যাবশ্যকীয়।
পরিবেশ নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে পরিবেশ ধ্বংসের জন্য যে সমস্ত স্টেকহোল্ডার দায়ী তাদেরকে অনেকটা ভিলেন হিসেবে বিবেচনা করে  প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা হয়। যেমন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো কখনোই কলকারখানার মালিক কিংবা এর সাথে জড়িত মানুষদের নিয়ে সেনসিটাইজেশন করার কোন উদ্যোগ আজও নজরে আসেনি। কিংবা শিশুশ্রম বা গৃহস্থলীতে শিশু নির্যাতন নিয়ে কাজ করার সময় যদি যে বাড়িতে শিশু কাজ করে তাদেরকে যদি বিবেচনায় না আনি তাহলে কাংখিত উন্নয়ন বা পরিবর্তন যাই বলি না কোন কোনটাই অর্জিত হবে কী?
পরিশেষে বলতে চাই, উন্নয়নকর্মী বা সমাজকর্মী যাই হই না কেন- আমাদের সমাজে এবং প্রকৃতিতে বিদ্যমান দ্বন্দ্বসমূহকে বুঝতে হবে এবং সেটিকে বিশ্লেষণ করার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। আর আমরা যখন দ্বন্দ্বকে স্বাভাবিক এবং সার্বজনীন হিসেবে বিবেচনা করতে পারবো তখনই সমাজকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হবো।

নোট: ছবিগুলো ইন্টানেট এর মুক্ত সোর্স থেকে সংগৃহীত।

চলো প্রশ্ন করি

আচ্ছা, অনেক বড় কিছু করতে গেলে কী লাগে? পৃথিবীতে কত বড় বড় মানুষ! কত বড় বড় কাজ! বড় বড় নাম! আর আমি?
এখনও বাবা-মা, শিক্ষকরা বলেন, ‘মানুষ হ’! আমিও মানুষ তারাও মানুষ।
কিন্তু
, সেই মানুষগুলোর সাথে আমার
কত আকাশ পাতাল পার্থক্য। এই ধর
, ক্রিকেটার সাকিব
আল হাসানের কথা- বয়সে বুঝি আমার সমান হবে। কিন্তু কোথায় সে আর কোথায় আমি
? তাকে সবাই এক নামে চেনে। আর আমি কোথাকার কে? তাকে সবাই পূজা করে (বাংলালিংকের ভাষায়- প্রিয়জনেরা একটু
বেশিই পায়।)
, আর আমাকে খোঁচা মারে!
বাংলাদেশের প্রথম সঙ্গীত বিষয়ক টিভি অনুষ্ঠানের (ক্লোজ আপ ১ তোমাকেই খুঁজছে
বাংলাদেশ)
থিম সংহচ্ছে,
যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে-
হবে হবেই দেখা, দেখা হবে বিজয়ে।
আচ্ছা লক্ষ্যমানে কী স্বপ্ন’? আমারও তো স্বপ্ন
আছে। প্রতি রাতে কত হাজারো স্বপ্ন দেখি। কিন্তু
, ঘুম ভাঙলেই দেখি বিছানায়- প্রকৃতির প্রবল আহবান! তাহলে স্বপ্নকী? ছোট বেলায় স্বপ্ন নিয়ে একটা লেখায় পড়েছিলাম, ‘মানুষ ঘুমিয়ে যত দীর্ঘ স্বপ্নই দেখুক, তার স্থায়িত্ব ৯ সেকেন্ড! স্বপ্ন নাকি আবার বর্ণান্ধ (কালার
ব্লাইন্ড)। স্বপ্নে নাকি রূপ
, রস, বর্ণ, গন্ধ নেই। তাহলে
স্বপ্ন কী
? ঘুম ভাঙলেই দেখি স্বপ্ন
টুটে (ভেঙে) যায়। তাহলে স্বপ্ন অটুট হবে কী করে
?
আমার এক বন্ধু (বন্ধবী)
আছে। সে মনে করে
, ‘তার জীবনে কী ঘটবে?
তা নাকি আল্লাহ পূর্বেই তাকে স্বপ্নের মাধ্যমে
জানিয়ে দেয়।
তাহলে সাকিব আল হাসান,
নীল আর্মস্ট্রং, কলম্বাস, স্যার আইজাক
নিউটন এদেরও কী সৃষ্টিকর্তা স্বপ্নে এসে বলে দিয়েছিলেন
? আমাকে কেন দেন না? আমার কী অপরাধ? আমিও তো অনেক বড় হতে চাই!
আমিও অনেক কিছু করতে চাই!
ভারতের ইতিহাসের প্রথম
মুসলমান রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবুল কালাম আজাদ এর নাম আমরা সবাই জানি। তিনি ভারতের
একজন পরমাণু বিজ্ঞানীও। তার সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। তিনি নি
ম্ন শ্রেণীর মুসলমান
ঘরে জন্ম গ্রহণ করেও দেশের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে ছিলেন। তাকে স্কুলে বসতে
দেয়া হতো না। তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে স্কুলের ক্লাস করতেন। তিনি অনেক
সুন্দর সুন্দর কথার মাধ্যমে তার জীবনের গল্প শুনিয়েছেন। তার স্বপ্ন নিয়ে একটা
সুন্দর কথা রয়েছে-
                “ যা তুমি ঘুমিয়ে দেখ তা স্বপ্ন নয়; যা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না তাই স্বপ্ন।
কথাটা আমার খুব প্রিয়।
সম্ভবত
, এ.পি. জে. আবুল কালাম
আজাদ এর স্বপ্ন ছিল এমন। যে স্বপ্ন তাকে ঘুমাতে দিত না। যে স্বপ্নের ফলে তিনি
দিনের চব্বিশ ঘন্টা সময়কে টেনে ৪৮ ঘন্টা করেছিলেন। আর তাই আজ তিনি স্বপ্ন দেখেন
না। স্বপ্ন দেখান। তাই আমাদেরও তার স্বপ্নের সাথে মিলিয়ে স্বপ্ন দেখতে হবে।
আচ্ছা বুঝলাম, বড় হতে হলে আমাকে স্বপ্ন দেখতে হবে। যে স্বপ্ন আমাকে খেতে,
বসতে, ঘুমাতে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। কিন্তু, কী স্বপ্ন দেখব? কেমন স্বপ্ন? কিসের স্বপ্ন?
আচ্ছা কীভাবে হযরত
মুহাম্মদ (সঃ)
নবুয়াতপেলেন? কীভাবে নিউটন মধ্যাকর্ষণশক্তি আবিষ্কার
করলেন
? কীভাবে মোহনদাস করমচাঁদ
গান্ধী
মহাত্মাহলেন? এই ৩ জনের নাম,
পরিচয়, ধর্ম এবং দেশ ভিন্ন হলেও তাদের মধ্যে কিন্তু একটা বড় মিল রয়েছে। আর সেটি
হচ্ছে- তারা
প্রশ্নকরতে পারতেন। খুবই আশ্চর্য তাই না?
কীভাবে শুধু প্রশ্ন করে
একজন সাধারণ মানুষ এত বড় অসাধারণ হতে পারে
? আমি ক্লাসে প্রশ্ন করলেই শিক্ষক বলেন, ‘গাধা’! বোকার মত প্রশ্ন
করিস কেন
? মুখটা তখন কালো হয়ে যায়।
মা-বাবাকে প্রশ্ন করলে ধমক দিয়ে বলেন
, বেয়াদপ! বড্ড পেঁকে গেছো! তখন মনে মনে কান ধরে বলি, জীবনে আর কখনো কাউকে মরে গেলেও প্রশ্ন কররো না। তাইতো
বিশ্বাস হয় না! কীভাবে একজন মানুষ প্রশ্ন করার মাধ্যমে বড় হতে পারে
?

 একটু চিন্তা করো। মহানবী (সঃ) এর প্রশ্ন ছিল- আমি কে? কে আমাকে সৃষ্টি
করলো
? কে এই মহাবিশ্বকে সৃষ্টি
করলো
?’ এই প্রশ্ন তিনি কার কাছে
করেছিলেন
? হয়তো তার সহপাঠী, বন্ধু কিংবা চাচা অথবা বয়স্ক কারও কাছে। তারা কী করলো?

হাসি ঠাট্টা করল। পাগল
ভাবল। তিনি কী প্রশ্ন করা বন্ধ করলেন
? না তিনি যখন অন্য কোথাও তার প্রশ্নের উত্তর পেলেন না। তখন তিনি নিজের কাছে
প্রশ্ন করলেন
? শুধু নিজের কাছে প্রশ্ন
করে বসে থাকলেন না। নিজে নিজে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলেন এবং
প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়ে হয়ে গেলেন
বিশ্বনবী’, ‘মহানবী। অর্থা তিনি প্রশ্ন করলেন নিজের কাছে।
একই ভাবে স্যার আইজাক
নিউটন প্রশ্ন করলেন
, ‘কেন আপেল নিচে পড়ল?
এত জায়গা থাকতে কেন আপেলকে নিচে আসতে হবে?
আপেল নিচে নামার প্রশ্নের উত্তর যখন খুঁজে
পেলেন তখন তিনি হয়ে গেলেন তার সময়কার শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। তিনিও বড় হলেন নিজেকে
প্রশ্ন এবং উত্তর খোঁজার মাধ্যমে।
মহাত্মা গান্ধী যখন
দক্ষিন আফ্রিকায় ছিলেন। তখন তিনি সেখানকার এক রেলস্টেশনে চরম লাঞ্ছনার শিকার হন।
সেই রেলস্টেশনের প্লাটফর্মের সাইনবোর্ডে লেখা ছিল
,                                                   
       
                        “Dogs and Indians are not allowed

মানুষ হয়েও কেন মানুষের
সাথে পশুরমত আচরণ। তার মন কেঁদে উঠল। কেন এমন হবে
? তিনি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য প্রচার করলেন অহিংসার
বানী। কোন পাশবিক যুদ্ধ
, বিগ্রহ, বিদ্রোহ নয়। তাই তো তিনি আজ মহান+আত্মা’= ‘মহাত্মা

বুঝলে, কীভাবে প্রশ্ন মানুষকে বড় করে তোলে! তবে প্রশ্ন অবশ্যই
নিজের কাছে। আর একটা বিষয় প্রশ্ন ভুল
, অবান্তর বা অযৌক্তিক নয়। প্রশ্ন প্রশ্নই। ভাল প্রশ্ন, খারাপ প্রশ্ন বলে কিছু নেই। তাই মনে কোন দ্বিধা, সংশয়, সন্দেহ এর উদয়
হলেই প্রশ্ন করো। আর প্রশ্ন করে বসে থাকলে হবে না। সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের
করতে হবে
, যেভাবেই হোক (by hook or crook)। নুবাবা-মায়ের কাছে অনুরোধ- আপনাদের সন্তান যদি বেশি প্রশ্ন
করে। তবে বিরক্ত হবেন না। দয়া করে আপনার সন্তানকে বকবেন না।
বরঞ্চ, প্রশ্ন করতে
উদ্বুদ্ধ করুন এবং তাকেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাহায্য করবেন। দেখবেন সে নিশ্চয়
পারবে এবং ভবিষ্য
প্রশ্নের জন্য আপনাকে বিরক্ত করবে না। নিজে নিজেই খুঁজে
নেবে।

প্রশ্নের উত্তর খুঁজে কী
লাভ
? অনেক লাভ! নিজের শক্তি-সামর্থ্য, নিজের সম্পদ-সম্পত্তি, আত্মবিশ্বাস-আত্মতৃপ্তি সবকিছুই খুঁজে পাওয়া যায়- প্রশ্নের
উত্তর খোঁজার মাধ্যমে। নিজের হৃদয়ে আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয়। তাই তো
, এভারেস্ট বিজয়ী মুসা ইব্রাহীম দৃঢ় চিত্তে বলেন,- ‘পৃথিবীর একজন মানুষও যদি পারে। তাহলে মুসা ইব্রাহিমও পারবে।

প্রশ্নের উত্তর খোঁজা কী
খুব সহজ
? কক্ষনোই না! তোমার মনে যে
প্রশ্ন। তার উত্তর বাজারে প্রচলিত কোন গাইড বইয়ে নেই। যে বাজর থেকে গাইড বই কিনে
এনে উত্তর খুঁজে পেলাম। আর মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখে দিলাম। ব্যস
, পেয়ে গেলাম গোল্ডেন প্লাস। 

এই প্রশ্নের উত্তর জীবনের
পরতে পরতে লুকায়িত। খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্ট সাধ্য। সাপের মাথার মানিকের মত। এই
প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পৃথিবীর নিয়ম ভাঙতে হয়। এ.পি.জে. আবুল কালাম আজাদ এর আরেকটি
কথায় ফিরে যাই। তিনি বলেছেন
, ‘পৃথিবীতে কিছু
মানুষের জন্ম হয় পৃথিবীর নিয়ম মেনে চলতে। আর কিছু মানুষের জন্ম হয় পৃথিবীর নিয়ম
ভাঙতে। আমার দরকার নিয়ম ভাঙার মানুষ গুলোকে।

সুতরাং, যা চলে আসছে তাই যে, ‘সত্য’, তা কিন্তু,
ঠিক নয়। নতুন কিছু হতে পারে আরো সঠিক বা
যর্থার্থ। তাইতো
, আমাদেরকে নিয়ম ভাঙার দলে
ভিড়তে হবে। ভাবতে হবে নতুন কিছু। হতে হবে সৃজনশীল
, কৌশলী। দৃঢ় প্রত্যাশার (প্রত্যয়+আশা)সাথে থাকবে আত্মবিশ্বাস;
হতে হবে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ- অবশ্যই নিজের কাছে।
হতে হবে পরমতসহিষ্ণু
, শ্রদ্ধাশীল, উদার এবং বিশ্বজনীন। নিজেকে ভাঙতে হবে, গড়তে হবে। তাহলে হয়তো পৌঁছে যেত পারবো আমার অটুট লক্ষ্যে।


যাক বড় হওয়ার ট্যাবলেট
(সূত্র) আবিষ্কার করে ফেললাম। এখন পানি দিয়ে গিলে দেখি বড় হতে পারি কী না
?
…..যদি বড় হতে পারি! তাহলে, বড় হওয়ার গল্প শোনাব আর…. একদিন…….।

নাম-১: ধর্ম নিরপেক্ষ নামের সন্ধানে

নামে কি আসে যায়? কে জানি বলেছিল এই কথা? মনে রাখার চেস্টাও করিনি। কিন্তু, একজন মানব নাম জন্মের অনেক পরে হলেও নাম ই একমাত্র
চিরস্থায়ী বস্তু। আকজন মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালবাসে তার নামকে। বিশ্বাস না হয়। কারো
নামে গালি দিয়ে দেখতে পারেন।
আমরা কেউ আদম- হওয়া,
সক্রেটিস, আইনস্টাইন কে দেখি নি। তবুও তারা আমাদের কত পরিচিত। আপনি
একদিন থাকবেন না
; কিন্তু আপনার নাম কিছুদিন
হলেও থাকবে (নুন্যতম ৩ প্রজন্ম পর্যন্ত)।
যাইহোক, প্যাচালে আসি। নাম কি শুধুই শব্দের সমষ্টি? নাকি এর সাথে যুক্ত আরও অনেক কিছু।
ধর্ম নিরপেক্ষ নামের
সন্ধানে
সেদিন, আমার ১ জন মানুষের সাথে পরিচয় হল নাম অন্তরা‘ (বলেন তো নামটি
কোন লিঙ্গের)। আমি শুনেই মনে হল তিনি হিন্দু
, তাই দিদি বলে সম্বোধন করে বিব্রত হলাম। আচ্ছা, কোন মানুষের নাম শোনার সাথে সাথে ধর্মের বিষয়টি আমার অবচেতন
মনে আসলো কেন
? আচ্ছা ধর্মের বিসয় আসলেও
কেন তা সম্বোধনের সাথে সম্পর্কিত। তার নামে নাম কি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে
ধর্মকে প্রতিনিধিত্ব করে
?
আচ্ছা কিছু নাম দেখি বলেন
তো এরা কোন ধর্মের
?
পলাশ, শিমুল, জয়া, জুথি, নিউটন, 
শিল্পী, প্রেমিশা, প্রিয়ম, ইমন,
রতন, রাখি, তনু,
রাজু, প্রভৃতি।
এই নাম গুলো কোন ধর্মের
ঝালর  বহন করে না। তাহলে কি নামের সাথে
ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই
?
এবার আসি নামের পদবীতে-
নামের পদবি নানা ভাবে সময়ের পরিক্রমায় নির্ধারিত হয়। যেমন ধরেন গাজী
, শাহ, প্রভৃতি। এখন
এগুলোর সাথে ধর্মের যোগসাজস কোথায়
?
সেদিন একজন মানুষের সাথে
পরিচয় হলাম
, আমার নাম বলার পর তিনি
বললেন তন্ময়। আমি ভাই হিসবে সম্বোধন করলাম এবং দেখ হলে সালাম দিতাম। পরে জানলাম
,
তার নাম তন্ময় কর্মকার। এখন আর সালাম দিতে পারি
না এবং দাদা  বলে ডাকার চেস্টা করি।
যাইহোক, নিচের পদবী গুলো থেকে বলুন তো এরা কোন ধর্মের?
সরকার, ঠাকুর, মণ্ডল, ঢালী, চৌধুরী, প্রভৃতি।
নামের পূর্বের অংশ দিয়ে
নাকি বোঝা যায় কোন ধর্মের অনুসারী। একসময় বাংলায় মুসলমানদের নামের আগে মোঃ ব্যবহৃত
হত আর হিন্দুদের ক্ষেত্রে শ্রী। যদিও এখন সবায় সেতা ব্যবহার করতে অনেক অনীহা দেখা
যায়।
যাই হোক,  নাম দিয়ে কি একজন
মানুষের ধর্ম সম্পর্কে কি নিশ্চিত হতে পারি
?
(জানিনা, কোথা থেকে কোথায় আসলাম)
আপনাদের মুল্যবান আলোচনা
লেখাটাকে সমৃদ্ধ করবে।

বোরখা, রোকেয়া এবং আমরা

কিছুদিন আগে মহাখালী’র ইন্সটিটিউট অফ পাবলিক হেলথের ক্যান্টিনে বসে সকালের নাস্তা খাচ্ছিলাম। আমি এবং আমার বন্ধু তৌহিদ।  আমাদের পাশের টেবিলে ২ জন মানুষ এসে বসল। একজন পুরুষ আর একজন নারী। পুরুষ টি সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরিহিত। মুখে চাপ দাড়ি, গাত্র বর্ণ, উচ্চতা ঘটনার সাথে সামঞ্জস্য নয়। আর নারীটি কালো বোরখা পরিহিত। দুইজনেই মধ্যবয়সী এবং স্বামী-স্ত্রী মনে হলো তাদের কথাবার্তা এবং আচরণে। দেখে বোঝাই যায় দুজনে শহুরে জীবন যাত্রায় এখনও অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি।

যাইহোক, দুজনে সকালের খাবারের জন্য রুটি আর ডাল-ভাজি অর্ডার দিল। আমাদের অর্ডার আগে আসতে দেরি হচ্ছে। আমি বসে থেকে আশে পাশে দেখছিলাম (এটা আমার একটা অভ্যাস-খারাপ কি ভাল জানি না। সব কিছু-মানুষের খাওয়া, কথা বলা কিংবা কাজ করা প্রভৃতি।) ইতমধ্যে, একজন পুরুষ সম্ভবত আইসিডিডিআর’বি- এর স্টাফ (আইডি কার্ডের ফিতা দেখে তাই মনে হোল) এসে সেই নারী-পুরুষের টেবিলে বসল। নতুন আগত ব্যক্তি এই ক্যান্টিনের নিয়মিত কাস্টমার। উনি ওনার প্রতিদিনের স্বাভাবিক আচরণে কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নাস্তা করতে লাগলেন।
এই পরিস্থিতিতে অস্বস্তিতে পড়লেন নারীটি। পুরুষটি ফোনে কথা বলতে বলতে খাইতে লাগলেন আর নারীটি কি করবে? না করবে? পুরুষ টি খেতে লাগলেন নির্দ্বিধায়- আর নারীটি অনেক ভেবে চিন্তে ধীরে ধীরে রুটির টুকরো ছিড়ে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরে নেকাব তুলে  আস্তে আস্তে মুখে দিলেন। রুটি ডাল ছাড়া। একটু প্ররে পুরুষটি কে তার ডালের বাটিটাও এগিয়ে দিলেন। নারীটি দুটি তন্দুর রুটি কোন কিছু ছাড়াই শুকনো খেয়ে ফেললেন।
কি এমন বিশ্বাস যে তাকে এই ধরনের আচরণে বাধ্য করলো। জীবন ধারনের জন্য খাওয়ার চেয়ে নেকাব রক্ষা করা কি এতই জরুরী। তিনি একান্ত বাধ্য না হলে নিশ্চিত এই পুরুষ সমাগত হোটেলে আসতেন না। কিংবা আমরা পুরুষরা কিভাবে নির্বিচার ভাবে নিজেদের উদার পূর্তিতে ব্যস্ত।
এই ঘটনা আমার দেখা এই প্রথম না।এবং শুধু মধ্যবয়সী কিংবা পৌঢ় নয়; তরুণ এবং নতুন মেয়েদের ক্ষেত্রেও (যারা শহুরে জীবনের এবং তথাকথিত ‘আধুনিক’ শিক্ষায় শিক্ষিত)। 

অনেক আগে যখন রোকেয়া সমগ্র পড়েছিলাম। এখন ঘটনা টা ঠিক হুবহু মনে নাই। কিন্তু যতদূর মনে আছে উনি ট্রেনে ভ্রমণ করছিলেন। একজন পর্দায় আবৃত নারী বিপদে পড়েছেন। কিন্তু পর্দা নষ্ট হবে বলে তার সহযাত্রী এবং বিপদাক্রান্ত নারী নিজেও কাউকে সাহায্য করতে দিচ্ছেন না।
বেগম রোকেয়ার যুগ এখন আর নাই। কিংবা আমরা পুরুষরা আমাদের সুখ- সুবিধা গুলো দেখছি। কিন্তু আমাদের আর একটি অংশকে পর্দার নামে বাইরে বের করে মানসিক অত্যাচার করছি কি না? নিজের বিবেক বারবার সেই প্রশ্ন করছে আমাকে।