মাকে ভালোবাসি

আজ মা দিবস! পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও ইংরেজি বছরের মে মাসের ২য় রবিবারকে মা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এ বছর মে মাসের ২য় রবিবার ১৪ তারিখ হওয়ায় আজ ‘মা দিবস’। মা দিবস পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ দেশে পালিত হলেও সবদেশে কিন্তু একই দিনে পালিত হয় না। বছরের প্রায় ৩০টি ভিন্ন ভিন্ন দিনে পালিত হয় মা দিবস। অনেক দেশে বিশেষ করে পূর্বের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে নারী দিবসেই একসাথে ‘মা দিবস’ পালন করা হয়। সবাই যে আবার ইংরেজি ক্যাল্ডোর অনুসরণ করে তাও কিন্তু নয়। নেপাল যেমন বৈশাখ মাসের অমাবস্যাকে কেন্দ্র করে মা দিবস পালন করে; তেমনি ইরান ইসলামিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে ২০ জমাদিউস সানিতে আর ইসরাইল ২২ মে মা দিবস পালন করে থাকে। মা দিবস ঘিরে রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। বলা হয়ে থাকে এই দিবস উদযাপন নাকি পুঁজিবাদ এবং ব্যবসা বাণিজ্যের ফসল। কিন্তু মা দিবস বিংশ শতকের গোড়ার দিকে শুরু হলেও এর শিকড় প্রত্থিত রয়েছে সূদূর অতীতে। প্রাচীন গ্রিক, রোমান ও খ্রিস্টান সভ্যতায় মাতৃত্বকে ঘিরে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালনের প্রমাণ পাওয়া যায়।
আধুনিক মা দিবস পালনের পথিকৃত ধরা হয় যুক্তরাষ্ট্রের আনা মারিয়া রিভস জার্ভিসকে। তিনি তার মায়ের সম্মান এবং কাজকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ১৯০৮ সালে মা দিবস পালন করেন এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য জোর আন্দোলন চালান। তবে তার আন্দোলন একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অর্জন করে; অন্যদিকে এই দিবসকে ঘিরে বিভিন্ন কার্ড, চকলেট, বেকারি, গিফটসহ নানা প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ের প্রসার ঘটাতে থাকে। আনা মারিয়া রিভস জার্ভিস মা দিবসের এই ধরনের বাণিজ্যিকীকরণের তীব্র বিরোধিতা করে আন্দোলন চালান এবং গ্রেপ্তারও হন।
মা দিবস উদযাপন করা হয় মা, মাতৃত্ব, মাতৃত্বের বন্ধন এবং সমাজে মায়ের ভূমিকাকে স্বীকৃতি এবং সম্মান জানানোর জন্য। মা হওয়া কিংবা সন্তান জন্মদান এবং লালন-পালন স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক বিষয় হলেও সমাজ এবং সংস্কৃতির নির্মাণ, বিকাশ এবং টিকিয়ে রাখতে ‘মা’ এর ভূমিকাই অগ্রগণ্য। নতুন প্রজন্ম গর্ভে ধারণ, জন্মদান, বুকের দুধ খাওয়ানো, শিক্ষা দান, সামাজিকীকরণসহ অসংখ্য কাজ করে থাকেন একজন মা। একটি সমাজ, সংস্কৃতি এবং সভ্যতার বিকাশে তাই একেবারে পিছন থেকে প্রাথমিক এবং মূখ্য কাজগুলো সম্পাদন করে থাকেন একজন মা। তাই এটি মানব সমাজ এবং সভ্যতারই দায় এবং দায়িত্ব সেই ‘মা’ কে আলাদাভাবে বিশেষ সম্মান জানানো। পাশাপাশি, সমাজের যে সমস্ত সদস্য ‘মা’ কে অবহেলা, বঞ্চনা এবং নিপিড়ীন করে থাকেন তাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো মায়ের অবদান, ত্যাগ, ভালোবাসা, মমতাকে।  আর এটি করতে গিয়ে বছরের ৩৬৫ দিনের একটি দিন মায়ের নামে উৎসর্গ করলেও বা ক্ষতি কী!
তাই আসুন মাকে ভালোবাসি। অনেক ব্যস্ততার মাঝে ‘মা’ এর জন্য প্রতিদিন একটু সময় বের করি। ‘মা’র খোঁজ নিই। তার পাশে বসি। মা কিন্তু আমাদের কাছ থেকে প্রতিদান চান না, আদর চান না, কোন সেবা কিংবা কোন আবদারও হয়তো নেই। শুধু একটাই প্রত্যাশা- ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’
প্রাণ ও প্রকৃতির সবচেয়ে চিরন্তন, সংবেদনশীল এবং টেকসই কাজ হচ্ছে জন্মদান বা মাতৃত্ব। আর এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নারী। তাকে আমরা ‘মা’ হিসেবে সম্বোধন করে থাকি বা চিনে থাকি। সবচে’ মজার এবং আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে ‘মা’ এর অস্তিত্ব সকল প্রাণ এবং প্রকৃতিতে বিরাজমান। অনেক উদ্ভিদ এবং প্রাণ সমাজে বাবাকে চিহ্নিত করা সম্ভব না হলেও মা কে  চিহ্নিত করা সম্ভব। তাই তো প্রাণ এবং প্রকৃতির এক চিরন্তন সত্ত্বা হচ্ছে ‘মা’।
‘মা’ মানে মাটি। ‘মা’ মানে প্রাণ। ‘মা’ মানে প্রকৃতি; ‘মা’ মানে আমাদের এই পৃথিবী। আর এই পৃথিবী ‘মা’ এর সর্বশ্রেষ্ঠ (মানুষের দাবি অনুসারে) সন্তান যেহেতু মানুষ; তাই মানুষের দায় তার নিজের মানব ‘মা’ কে ভালোবাসা, সম্মান আর স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি মাটি ‘মা’কে, প্রাণ-প্রকৃতি ‘মা’কে সর্বোপরি এই পৃথিবী ‘মা’কেও ভালোবাসা, সম্মান আর স্বীকৃতি জানানোর। কারণ আমাদেরই ‘মা’ই যে আর সব ‘মা’ (মাটি, প্রাণ-প্রকৃতি, পৃথিবী) এর প্রতিরূপ। শুধু আমাদের মানব ‘মা’কে ভালো রাখলে কিন্তু হবে না। আমাদের মাটিকে ভালো রাখতে হবে, সকল প্রাণ এবং প্রকৃতিকে ভালো রাখতে হবে। এই পৃথিবীকেও সবুজ, শ্যামলে ভরে রাখতে হবে। তবেই আমাদের ‘মা’ও ভালো থাকবে। ‘মা’ যে মাটিতে হাঁটবেন, যে উদ্ভিদ এবং প্রাণী খেয়ে বাঁচবেন, যে পৃথিবীতে বুক ভরে নিশ্বাস নেবেন- সেগুলো যদি দূষিত, ধ্বংস আর বিষাক্ত হয়ে যায়; তাহলে ‘মা’ কি সুস্থ, সুন্দর আর দীর্ঘজীবী হয়ে আমাদের পাশে থাকবেন? কক্ষনোই নয়।

ভালোবাসা ছড়িয়ে যাক প্রাণ ও প্রকৃতিতে!


১৪ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। প্রতিবছর সারা পৃথিবীর মানুষ ভালোবাসা দিবস উদযাপন করে ব্যক্তিক কিংবা সামষ্টিকভাবে। বিশেষ করে বয়োঃসন্ধিকালীন ছেলেমেয়ে এবং আপত তরুণদের মাঝে এই দিনটির বিশেষত্ব লক্ষ্যণীয়। এটির ইতিহাস, সাংস্কৃতিক পরিচয় কিংবা উদযাপনের ধরণ এবং ঢং নিয়ে রয়েছে হাজারো আলোচনা ও সমালোচনা। তবে সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে-এই দিনটিতে সারা পৃথিবীতে এক ধরনের ‘পজিটিভ ভাইভ’ বিরাজ করে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এই পজিটিভ ভাইভটার খুব বেশি প্রয়োজন।
পৃথিবী তার সৃষ্টিলগ্নে ছিল উত্তপ্ত। তারপর ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকে। সেই শীতল অবস্থা থেকে এই সবুজ পৃথিবীর ‘সবুজ অধিবাসী’রাই পৃথিবীকে বাসযোগ্য উষ্ণ করে তুলেছে। সবুজ অধিবাসী বলতে পৃথিবীতে বিরাজমান লক্ষাধিক প্রাণকে বোঝানো হচ্ছে। তারা তাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অর্থাৎ জীবনধারণ এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে বাসযোগ্য উষ্ণ করে তুলেছে। আজকের এই সভ্য পৃথিবীর দাবিদার যতটুকু মানুষ! ঠিক ততটুকুই কিংবা তারও অধিক দাবিদার বাদ বাকি প্রাণ। কিন্তু মানুষ নামক দাম্ভিক (!) প্রাণী নিজেকে ‘ফোকাস’ করতে গিয়ে আর সকল প্রাণকে ‘ডি-ফোকাস’ করে ফেলেছে। তাই তো পৃথিবীকে উষ্ণ করতে গিয়ে ধীরে ধীরে বৈশ্বিক উষ্ণতার মতো সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা’র জন্য প্রাকৃতিক কারণ এর সাথে শুধু মানুষ্য সৃষ্ট কারণই জড়িত। অন্য কোন প্রাণ এর জন্য দায়ি নয়। কিন্তু এই বৈশ্বিক উষ্ণতার মতো সমস্যা সমাধানে মানুষের প্রয়োজন পৃথিবীতে বিদ্যমান সকল প্রাণীর সহযোগিতা।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বলতে শুধু প্রাকৃতিক উষ্ণতাই নয়। এর সাথে সাথে সমাজিক-সাংস্কৃতিক উষ্ণতাকেও বিবেচনা করা হচ্ছে। দিনকে দিন এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে সমান্তরালভাবে। যুদ্ধ, সন্ত্রাস, সামাজিক সহিংসতা, নির্যাতন, প্রতিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের মতো হাজোরো সমস্যায় জর্জরিত বর্তমান পৃথিবী এবং মানুষ। এই সমস্যার নেতিবাচক প্রভাব শুধু মানুষ একা ভোগ করছে না; অন্য প্রাণও সংকটের সম্মূখীন। কিন্তু একমাত্র মানুষই পারে এই সমস্যা থেকে উত্তোরণ করাতে। অন্য প্রাণ হতে পারে সহযোগী, সহযাত্রী; কিন্তু নেতৃত্ব মানুষকেই দিতে হবে।
ভালোবাসা দিবসে যে ‘পজিটিভ ভাইভ’ বিরাজ করে সেই পজিটিভ ভাইভটা হতে পারে এই বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের প্রাথমিক ধাপ। কিন্তু সেটি শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। আরো নির্দিষ্ট করে বললে শুধুই আমাদের ভালোবাসার মানুষ কিংবা সবচেয়ে নিকটজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সেটি কী এই স্বল্প গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে? আসুন এই গন্ডি থেকে বেরিয়ে আসি।
এই ভালোবাসা দিবসে ভালোবাসা বিলিয়ে দেই আমাদের সবচেয়ে দূরত্বের সম্পর্কের মানুষের জন্য। যে ব্যক্তিটির সাথে আমাদের সবচেয়ে খারাপ সম্পর্ক; আসুন এই ভালোবাসা দিবসে তাকেই ভালোবাসি। তাকে একটি ফোন দিয়ে জানাই ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা। ভালোবাসা দিবসে আমরা ফুল ও চকলেট উপহার দিতে ভালোবাসি। সেই ‘শত্রু’কেই দিই ফুল আর চকলেট। দেখবো আমাদের জীবনটা আরো বেশি ভালোবাসায় ভরে উঠবে।
ভালোবাসা দিবসে আমরা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ভালোবাসা বিলিয়ে দিতে চাই। চলুন না বিলিয়ে দিই যার সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা প্রয়োজন সেই মানুষটাকেই। হয়তো আপনার আমার পরিচিত কেউ মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত; তাকেই জানাই আমাদের ভালোবাসা। কিংবা আমাদের আশেপাশের হাজারো ভালোবাসা (!) বঞ্চিত মানুষ আছে- আসুন তাদেরকেই ভালোবাসি। ভালোবেসে ব্যবস্থা করি একবেলার খাবার- ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের পরিবর্তে। কিংবা প্রয়োজনীয় সেবা। আসুন ভালোবাসা দিবসে ছুটি নিয়ে-ভালোবাসার মানুষটিকে সঙ্গে নিয়ে সময় কাটাই কিছু ভালোবাসা বঞ্চিত নারী, শিশু এবং প্রবীণ নাগরিকের সাথে। ভালোবাসা দিবসে আসুন রক্ত দেই। কিংবা ব্যস্ত দিনের হাজারো ব্যস্ততার মাঝে একটি অন্তত ভালো কাজ করি।

ভালোবাসা কি শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? আমরা কী শুধু মানুষ নিয়েই বেঁচে থাকি? মানুষ ছাড়াও আমাদের চারপাশে হাজারো বস্তুগত এবং অবস্তুগত উপাদান রয়েছে। সেই সমস্ত উপাদানগুলোকে কি ভালোবাসা যায় না? আমরা যে বায়ু গ্রহণের মাধ্যমে বেঁচে আছি-সেই বায়ুকে চলুন ভালোবাসি। দূষিত বায়ুকে কম দূষিত করি (কম কার্বণ নিঃসরণ করা) কিংবা বিশুদ্ধ করার (গাছ লাগানো) উদ্যোগ নিয়ে বায়ুকে ভালোবাসি। আসুন মাটিকে ভালোবাসি; কম রাসায়নিক সার-কীটনাশক ব্যবহার কিংবা মাটি দূষণ কম করে।
ভালোবাসার অন্য এক প্রতিশব্দ হয়তো ফুল। আমরা প্রতিবার ভালোবাসা দিবসে ভালোবাসার মানুষটিকে ফুল উপহার দিই-খুবই ভালো কথা। এবার ফুলটিকেই ভালোবেসে একটি ফুলগাছ লাগাই। যেন আগামী ভালোবাসা দিবসে ফুল কেনা না লাগে। কিংবা ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষটিকেই হয়তো একটি ফুলগাছই উপহার দিলাম।
ভালোবাসা দিবসে অনেকেই মানবতার জন্য রক্তদান ক্যাম্প, চিকিৎসা ক্যাম্প, অর্থ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজন করি। নিঃসন্দেহে খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণীর জন্য স্বাস্থ্য ক্যাম্প কিংবা প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় অর্থ সংগ্রহ করতে কী পারি না-এই ভালোবাসা দিবসটিকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে। আসুন ভালোবাসা দিবসে কিছু না পারি প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের অন্তত ক্ষতি হয় এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকি।
কেন ভালোবাসার এই গন্ডি ভাঙা জরুরি? কারণ মানুষ একা বাঁচতে পারে না। আর তাই মানুষের প্রয়োজনেই মানুষের পাশাপাশি অন্য প্রাণ এবং প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিক্ষা দিক এই সার্বজনীন ভালোবাসা দিবস। এই দিনের ‘পজিটিভ ভাইভ’ একটি নির্দিষ্ট গন্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে আরো বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে দিতে পারলেই এই দিনটির প্রকৃত তাৎপর্য ফুটে উঠবে। পাশপাশি, শুধু মানুষে-মানুষে সীমাবদ্ধ থাকলে এক সময় মানুষ ছাড়া আমাদের চারপাশে আর কিছুই থাকবে না। আবার শুধু ভালোবাসার মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে আমাদের শত্রু সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। তাই ভালোবাসাতে হবে সবাইকে। আমাদের শত্রুকে; ভালোবাসা বঞ্চিত মানুষটিকেই। ভালোবাসতে হবে আমাদের চারপাশের প্রাণ, প্রকৃতি এবং প্রতিবেশকে। তবেই সম্ভব একটি ভালোবাসাময় পৃথিবীর। যেটি হবে আরো বেশি উপযোগী, স্বাচ্ছন্দ্য এবং  টেকসই সকল প্রাণের জন্য।
    ** ছবিগুলো সংগৃহীত

আমি প্রকৃতির, প্রকৃতি আমার

‘পরিবেশ দিবস’ কথাটা মাথায় আসলে মনে হয় গাছ লাগাই। পরিবেশ দিবস পালিত হয় প্রতিবছর ৫ জুন। আর জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের বর্ষা ঋতু। যা গাছ লাগানোর জন্য একবারেই উপযোগি। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে দেখে আসছি পরিবেশ দিবস উপলক্ষে গাছ লাগানো কার্যক্রম। একসময় পরিবশে দিবস উপলক্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয় এর শিক্ষার্থীদের মাঝে বন বিভাগ থেকে বিনামূল্যে গাছ বিতরণ কর্যক্রম চালু ছিল। তাই এখনো মাথার ভিতর পরিবেশ দিবস উপলক্ষে গাছ লাগানোর বিষয়টিই সবার আগে মাথায় আসে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পরিবেশের সমার্থক শব্দ কি তাহলে গাছ? পরিবেশের অন্যতম উপাদান কি তাহলে গাছ? নাকি পরিবেশ রক্ষা করতে শুধু গাছই যথেষ্ট?
পরিবেশ দিবসের সংজ্ঞাটা একটু দেখে নেওয়া যাক। বাল্য বয়স থেকে শিখে এসেছি ‘আমাদের চারপাশে যা আছে তাই নিয়ে আমাদের পরিবশে।’ আমাদের চারপাশে কি শুধু গাছ থাকে; কখনোই নয়! আমাদের চারপাশে গাছ ছাড়াও রয়েছে নানান প্রাকৃতিক উপাদান। উদ্ভিদ, প্রাণী, মাটি, বায়ু, নদীনালা, খালবিল, পাহাড়, অরণ্যসহ অসংখ্য উপাদান। তবে এটা ঠিক যে, আমাদের চারপাশে প্রকৃতির অসংখ্য উপাদানের মধ্যে গাছ একটি। গাছের সাথেই আমরা বেশি পরিচিত হই। এটাও ঠিক যে, গাছই আমাদেরকে বাঁচায়। কারণ গাছ যদি অক্সিজেন উৎপাদন বন্ধ করে দেয় তাহলে মানুষসহ অক্সিজেনের ওপর নির্ভরশীল অসংখ্য প্রাণী নির্ঘাত মারা যেতো। তাই গাছ লাগানো অবশ্যই একটা ভালো উপায় হতে পারে পরিবেশকে ভালো এবং সুস্থ রাখার জন্য। তবে সামগ্রিকভাবে পরিবেশ তখন ভালো ও সুস্থ থাকবে যখন গাছের পাশাপাশি আমাদের চারপাশের অবস্থানকারী গাছসহ ঘাস, গুল্ম, মাটি, বায়ু, নদীনালা, খালবিল, ক্ষুদ্র ও বৃহৎ প্রাণী প্রতি যত্নবান ও দায়িত্বশীল হই। দায়িত্বশীল ও যত্নবান হলে আমরা এগুলো ধ্বংস করবো না, কেউ যাতে এগুলো ধ্বংস না করতে পারে তার জন্য আমরা সোচ্চার হবো।

পরিবেশকে শুদ্ধ, নির্মল ও সুস্থ রাখার জন্য শুধু গাছ লাগালে চলবে না; তা কিন্তু যথেষ্টও নয়। গাছ ছাড়াও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানকে ভালো রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রকৃতিতে একটি ঘাস, একটি গুল্ম, একটি ছোট প্রাণী, একটি বহৎ প্রাণীকে ভালো রাখার উদ্যোগ নিতে হয় মানুষকে। শুধু তাই নয়। এ গাছ, ঘাস, গুল্ম যাতে সবল ও সতেজ হয় এজন্য মাটিকেও যত্ন রাখতে হয়। যত্ন রাখতে হয় নদী, নালা, খাল বিলকেও। কারণ প্রাকৃতিক উপাদান প্রতিটিরই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। একটি প্রাকৃতিক উপাদান বিলুপ্ত হলে এর প্রভাব অন্য উপাদানের ওপরও পড়ে। এজন্য পরিবেশকে সুন্দর, ভালো, নির্মল ও বিশুদ্ধ করার জন্য পরিবেশ তথা প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকেই আমাদের চিনতে হবে, জানতে হবে এবং বুঝতে হবে। গাছের মতো করে অন্যান্য উপাদানকেও যত্ন করতে হবে, তাদেরকে সংরক্ষণ করতে হবে এবং সেগুলোর বিস্তার ও বিকাশ করতে হবে। পরিবেশ ও প্রকৃতিকে জানার, বুঝার ও উপলদ্ধি করার এবারের পরিবেশ দিবস ২০১৭ এর প্রতিপাদ্য যথার্থ। কেননা এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়টি প্রকৃতির কাছকাছি কিংবা প্রকৃতির সাথে মানুষকে বসবাস করতে উৎসাহিত করছে। “Connect with Nature”এই প্রতিপাদ্যটি, যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার “আমি প্রকৃতির, প্রকৃতি আমার” শিরোনামে উদযাপন করছে, সেটি আমাদেরকে প্রকৃতিকে তার মতো করে উপলদ্ধি করার অবকাশ দিয়েছে।
প্রকৃতিকে সৃষ্টিকর্তা বৈচিত্র্যময়তায় পরিপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। এই বৈচিত্র্য বিনষ্ট হলে, লুপ্ত হলে পরিবেশের ক্ষতি হবে। ‘আমাদের’ বলতে শুধুমাত্র মানুষকে চিন্তা করলে মানুষ ভুল করবে, আমাদের বলতে অন্যান্য প্রাণ ও উপাদানকে নির্দেশ করে। আবার ‘চারপাশ’ মানে বিশ্বব্রহ্মান্ডের বিভিন্ন উপাদান ও সৃষ্টিকে নির্দেশ করে। পরিবেশকে ভালো ও নির্মল রাখতে হলে মানুষ যেমন তার মতো মানুষের প্রতি যত্নবান হতে হবে ঠিক তেমনি প্রকৃতির প্রতিটির সৃষ্টিকেও আপন করে নিতে হবে। কারণ পরিবেশের প্রতিটি উপাদানই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। তবে প্রকৃতির উদ্ভিদ, প্রাণী এবং মানুষ পরস্পরের ওপর তখন বেশি নির্ভরশীল হবে যখন প্রকৃতিতে বৈচিত্র্য থাকবে সমৃদ্ধ। এই বৈচিত্র্যের বিভিন্ন উপাদানকে ঘিরে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক শক্তিশালী হয়। পারস্পরিরক সম্পর্ক শক্তিশালী হলে পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানই ভালো থাকবে, বিকশিত হবে। যেমন, বিভিন্ন উদ্ভিদের ফল, ফুল আছে বলেই পাখিরা সেই উদ্ভিদের সংস্পর্শে আসে। সেই ফুল ও ফল খেয়ে বেড়ে উঠে। সেই উদ্ভিদের ফল ও ফুল খেয়ে মলের মাধ্যমে তারা অন্য এলাকায় এসব উদ্ভিদের জন্ম দেয়; বৈচিত্র্যকে আরও বিকশিত করে। আবার বনের বিভিন্ন ছোট ছোট উদ্ভিদ ও প্রাণী আছে বলেই পোকামাকড় থেকে শুরু করে বড় আকারের প্রাণীগুলো সেই সব ছোট উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংস্পর্শে আসে; খাদ্য হিসেবে যেমন সেগুলো গ্রহণ করে তেমনিভাবে সেগুলোকে লালন-পালন করে যাতে তাদের খাদ্যের কোন সমস্যা না হয়। এভাবে তাদের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক ও নির্ভরশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান সেটা খাদ্য হোক, ওষুধ হোক, ফল হোক পরস্পরের সাথে বিনিময় ও সহভাগিতা করার মাধ্যমে মানুষে মানুষে সম্পর্ক ও নির্ভরশীলতা তৈরি হয়। ‘আমাদের’ ও ‘চারপাশ’ প্রত্যয়টি দু’টির বিশ্লেষণে আমরা বুঝতে পারি, ‘পরিবেশ’ মানে মানুষসহ প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান ও প্রাণকে নির্দেশ করে। পরিবেশকে ভালো রাখতে হলে, সুস্থ রাখতে হলে এবং নির্মল করতে গেলে প্রতিটি প্রাণ ও উপাদানের প্রতি যত্নবান ও দায়িত্বশীল হতে হবে।
২০১৭ সালের প্রতিপাদ্য বিষয়টিকে বাংলায় রূপান্তর করলে দাঁড়ায় ‘প্রাণের স্পন্দনে, প্রকৃতির বন্ধনে’। প্রকৃতিতে প্রাণের স্পন্দন তখন স্পন্দিত হবে যখন প্রকৃতিকে তার মতো করে থাকতে দিই আমরা। প্রকৃতির বন্ধনে নিজেকে আবদ্ধ করতে হলে অবশ্যই এসব প্রাণের স্পন্দনকে বাঁচাতে হবে, বিকশিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন প্রকৃতির আলিঙ্গনে নিজেকে সমর্পণ করা। আমরা মানুষ প্রকৃতির সন্তান, প্রকৃতির কোল থেকেই আমরা বেড়ে উঠি এবং বর্তমান সময়ের সভ্য মানুষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছি।। কিন্তু সেই প্রকৃতি থেকে দিন দিন আমরা দূরে চলে যাচ্ছি। আমরা যারা শহরে থাকি প্রকৃতির সাথে আমাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগই নেই। আর আমরা যারা গ্রামে বাস করি আমরাও কেমন জানি দিনকে দিন প্রকৃতি থেকে দূরে সরে দাঁড়াচ্ছি। আমরা প্রতিদিন যে খাবার খাই সেটিও এতো বেশি প্রক্রিয়াজাতকরণ করা যে তাতে প্রকৃতির স্বাদ-গন্ধও বিন্দুমাত্রও নেই। আমাদের গায়ে লাগে না কাঁদা-মাটি; পানিও পান করি বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও রাসায়নিক পদার্থ মেশানো। প্রতিদিন হাজারো তথ্য প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হচ্ছি। কিন্তু প্রকৃতি সম্পর্কে থেকে যাচ্ছি অজ্ঞ। নতুন কোন গাছ চিনি না, ধান চিনি না, মাছ চিনি না। অন্যান্য ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র উদ্ভিদ আর প্রাণীর কথাতো বাদই দিলাম। আমরা কি জানি আমাদের চারপাশে কত ধরনের রঙ-বেরঙের প্রজাপতি আছে? কত ধরনের পাখি আছে? কত ধরনের ঘাস আছে? প্রকৃতি থেকে এই দূরত্ব হয়তো আমাদেরকে আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর এবং প্রযুক্তি নির্ভরশীল করে তুলছে। আর তাই এই পরিবেশ দিবস হতে পারে আমাদের জন্য এক সূবর্ণ সুযোগ প্রকৃতিকে জানার, চেনার বুঝার।
চলুন না আজ বেরিয়ে পড়ি খালি পায়ে। সবুজ ঘাসের বুকে কিছুক্ষণ হাটি। লাগুক পায়ে কাঁদা। চিনে নিই নতুন একটি উদ্ভিদ প্রজাতিকে। চলুন না ঘুরে আসি সবুজের কাছকাছি কোন একটি বাগান কিংবা পার্কে চিনে নিই নতুন ১০টি গাছ, পাখি, পোকা, ফড়িং, প্রজাপতি। কিংবা পরিচিত হই এমন একজন মানুষের সাথে যিনি প্রকৃতির সাথে একীভূত। তার সাথে গল্প করে জেনে নিই প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য। হারিয়ে যাই প্রকৃতির মাঝে, বিলীন হয়ে যাই।
হ্যাঁ, জানি এই একটি দিবস যথেষ্ট নয় প্রকৃতির সাথে একাত্ম হওয়ার জন্য। কিন্তু শুরুটা তো হতে পারে এই দিনেই। সবাইকে পরিবেশ দিবসের ২০১৭ এর শুভেচ্ছা।
বাহাউদ্দীন বাহার ও সিলভানুস লামিন
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় barciknews.com এ 

বর্জ্য পানিকে ব্যবহার উপযোগী করি

পানি কী কখনো বর্জ্য হয়? হয় কীভাবে? পানি বর্জ্য হয় যখন আমরা ভালো পানিটাকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছি; কিন্তু তার একটি বৃহদাংশ অব্যবহৃত রেখে যাচ্ছি। রেখে যাওয়া পানিটি হয়ে যাচ্ছে নোংরা বা বর্জ্য। এই বর্জ্য পানি আর ব্যবহারের উপযোগি থাকছে না। সাধারণত আমরা দু’ভাবে পানিকে বর্জ্য করে তুলছি। এক. গৃহস্থলীতে পানির অপচয় ও অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের মাধ্যমে। অন্যভাবে বললে আমরা আমাদের দৈনন্দিন কাজে পানির যে অপচয় করছি সেটিকেই বর্জ্য পানি বলছি। আর দুই. কৃষি, কলকারখানা এবং অপরিকল্পিত নর্দমার মাধ্যমে পানি দূষণের মাধ্যমে পানিকে বর্জ্য পানিতে পরিণত করি। পানিকে বর্জ্য পানিতে রূপান্তর করার প্রক্রিয়াটি আমরা অনেক সময় অজান্তে বা জেনে করে আসছি। আমরা যদি একটু সচেতন হই এবং আমাদের নিত্যদিনের পানি ব্যবহারের চিত্রটি পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাবো আমরা প্রতিদিনই নানাভাবে বিশুদ্ধ পানিকে বর্জ্য পানিতে রূপান্তর করে আসছি। পানির এই অপচয় (বর্জ্য পানি) সম্পর্কে সচেতন করার জন্য ২০১৭ সালে ২২ মার্চ আন্তর্জাতিক পানি দিবস এর প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে “পানি কেন বর্জ্য”? প্রতিবছর ২২মার্চ আন্তর্জাতিক পানি দিবস পালন করা হয় বিভিন্ন ইস্যু এবং সেই ইস্যু কেন্দ্রিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার জন্য। এবারের প্রতিপাদ্যের মূল বক্তব্য হচ্ছে পানির অপচয় (বর্জ্য) কমানো এবং ব্যবহার্য পানির পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করা।

আপনি কি পানি অপচয় করেন? বুকে হাত দিয়ে বলুন। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে যে, আমরা কেউ পানি অপচয় করি না। কিন্তু আমাদের ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃতভাবে পানির অপচয় করি নানাভাবে। আমাদের নাগরিক জীবনে সকালে উঠে ব্রাশ করার সময় পানির কল (ট্যাপ) খুলে রাখি। রান্নাঘরের সিঙ্কে পানি অনবরত পড়তেই থাকে। গোসলের সময় শাওয়ার কিংবা পানির কল থেকে পানি পড়তেই থাকে প্রয়োজন ছাড়াই। এতো গেলো শহুরে জীবন। গ্রামের জীবনেও পানির অপচয় কম নয়। টিউবওয়েল থেকে এক গ্লাস পানি সংগ্রহ করতে গেলে কমপক্ষে আরো ১০ গ্লাস পানি অপচয় করি। টিউবওয়েলে গোসল করতে গিয়ে কতো পানি অপচয় করি তার হিসাব কে রাখে। পুকুরের পানিকে থালা-বাসন, কাপড় ধোয়া কিংবা পশুপাখির অবাধ বিচরণে খাবার উপযোগী আর থাকেই না। এটি শুধু গৃহস্থালীতে ব্যবহার্য পানির অপচয়ের (বর্জ্য পানিতে পরিণত হওয়া) চিত্র। এই চিত্র আরো বেশি ঘনীভূত হয় কৃষিক্ষেত্র এবং কলকারখানায়। এটি শুধু বাংলাদেশের কথা নয়; সারা পৃথিবীতে পানি অপচয় হচ্ছে। প্রতিদিন আমরা নানাভাবে পানির অপচয় করে থাকি। যে পানি আমাদের প্রাণ, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাই বিনামূল্যে। সেই বিনামূল্যের পানিই আমরা অপচয় করি এবং পুনরায় কয়েকগুণ বেশি মূল্যে কিনে পান করি।
পানি এ মাহাবিশ্বের সবচেয়ে স্বাতন্ত্র্য একটি উপাদান। এটি এখনো পর্যন্ত কেবল আমাদের এই পৃথিবীতেই সন্ধান পাওয়া গেছে। তাই আমাদের এই নীল গ্রহেই কেবল পানির সন্ধান পাওয়া গেছে। অর্থাৎ পানি আছে বলেই আমাদের পৃথিবীতে প্রাণ আছে। পৃথিবীর মোট ভুখন্ডের ৩ ভাগ পানি এবং ১ ভাগ স্থল।  আবার এই ৩ ভাগ পানির প্রায় পুরোটাই (৯৬.৫%) সমুদ্রের লবণাক্ত পানি। আর পানযোগ্য পনি মাত্র ৩.৫%। এই স্বল্প পরিমাণ পানি সম্পদের প্রাকৃতিকভাবে সুষম বণ্টিত নয় পৃথিবীর সমগ্র এলাকায়। কোথাও পানির প্রাচুর্য্যতা রয়েছে (কানাডা, বাংলাদেশ); তো কোথাও তীব্র সংকট (সাহারা মরুভুমি বা উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু)। সমান্তরালভাবে একটি দেশের প্রতিটি অঞ্চলেও পানি সম্পদের সমান প্রাপ্যতা নেই। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এর সাথে যখন সামাজিক-সাংস্কৃতিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বণ্টন ব্যবস্থা জড়িয়ে পড়ে তখন এই পানি সম্পদ সত্যি সত্যি হয়ে ওঠে সম্পত্তি (!)। সাথে সাথে আরোপিত হয় ব্যবসা, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে ক্ষমতার দ্বান্দ্বিকতা। এই যখন সুপেয় পানির পরিস্থিতি; আর এর সাথে যদি পানির আপচয়যুক্ত হয় তাহলে সেটি কতটা ভয়াবহ হতে পারে- সেটি সকলেরই বোধগম্য।
পানি খুবই সহজপ্রাপ্য এবং বিনামূল্যে প্রাপ্য বলে আমরা এটি নিয়ে ভাবিই না। যথেচ্ছভাবে পানির অপচয় করে থাকি। পানি যে আজও কিনে খেতে হয়-সেটি আমরা মানতে নারাজ। কিন্তু আমাদের অগোচরেই এই পানি আমাদের কাছে মূল্যবান এবং দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে।  ঢাকা শহরের একটি পরিবার যে টাকা পরিশোধ করে সারা মাসের সবচেয়ে নিরাপদ পানি পায় সেই পানি দিয়ে পরিবারটি গৃহস্থালীর সকল কার্যক্রম (খাওয়া, রান্না করা, গোসল, পোশাক পরিষ্কার, ঘরবাড়ি ধোঁয়ামোছা এমনকি নির্মাণসহ নানাবিধ কাজ) সম্পাদন করে। সেই পানিটি কিন্তু নিরাপদ ও পানযোগ্য! ঠিক উল্টোই ঘটে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল যেখানে সুপেয় পানির স্বল্পতা রয়েছে। বিশষ করে উপকূলীয় অঞ্চল, পাহাড়ি অঞ্চল, উচ্চ বরেন্দ্রভূমি, বর্ষাকালে হাওড় অঞ্চলসমুহে। এছাড়াও আর্সেনিক, পানিতে আয়রন, লবণাক্ততা এবং ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার এই সমস্ত এলাকার সুপয়ে পানির সংকটকে আরো বেশি তীব্র করে তুলেছে। এই সমস্ত এলাকার একটি পরিবারের শুধু খাবার পানি সংগ্রহ করতেই ঢাকার চেয়ে কয়েকগুন বেশি টাকা (শ্রম এবং সময়ের মূল্য বিচেনায়) পরিশোধ করতে হয়। আবার একই এলাকার ধনী ও গরিবের মধ্যে পানির প্রাপ্যতা এবং সেটি সংগ্রহের ক্ষেত্রেও রয়েছে বৈষম্যমূলক চিত্র। তাই এই পরিস্থিতিকে আরো বেশি ভয়াবহ করে তুলছে আমাদের দৈনন্দিন পানির আপব্যবহার। উদাহরণ হিসেবে শহরের একটি টয়লেট একবার ফ্লাশ করার ফলে যে পরিমাণ (সুপেয় পনি) পানি অপচয়/অপব্যবহার করি। এই পরিমাণ পানি দিয়ে গ্রামের একটি চারজন সদস্যের পরিবারে এক দিনের খাবার পানির চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। অন্যান্য ক্ষেত্রে পানির এমন অপব্যবহার তো আরো ভয়াবহ।

জাতিসংঘের পানি বিষয়ক অধিদপ্তর এর তথ্য মতে, বিশ্বে গৃহস্থালীতে যে পরিমাণ পানি ব্যবহার করা হয় তার ৮০ শতাংশই বর্জ্য (অপচয়) হয়ে যায়। এই বর্জ্য পানি কোনভাবেই পুনঃব্যবহার বা প্রক্রিয়া ছাড়াই প্রতিবেশে ফিরে আসে। এই তথ্য আমাদেরকে বেশ নাড়িয়ে দেয়। আমরা আমাদের পরিবারে প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি ব্যবহার করি তার বেশিরভাগই অপচয় হয়ে নোংরা বা বর্জ্য পানিতে পরিণত হয়।শুধু গৃহস্থলীতে নয়; কৃষি ক্ষেত্রেও নানাভাবে পানি নষ্ট হয়ে যায়। কৃষিক্ষেত্র পানি নোংরা হওয়ার ঘটনাটা অপচয় হওয়ার চেয়ে ব্যতিক্রম। কৃষিতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক কীটনাশক বা সার ব্যবহারের ফলে কৃষিতে ব্যবহৃত পানি বিষাক্ত হয়ে ভূগর্ভস্থ এবং ভূপৃষ্ঠস্থ পানিকে বিষাক্ত করে তোলে। ফলে এই পানি আর ব্যবহারের উপযুক্ত থাকে না এবং বর্জ্য পানিতে পরিণত হয়। সেই হিসাবে কৃষি পানিকে বেশি বর্জ্য পানিতে পরিণত করে।কৃষি ক্ষেত্রের ন্যায় শিল্প কলকারখানাও একটি বড় অংশ বর্জ্য পানি তৈরি করে। কলকারখানায় ব্যহহৃত উচ্ছিষ্ট পানি সরাসরি ভূপৃষ্ঠ এবং জলাশয়ে নিষ্কাশনের ফলে ভূগর্ভস্থ এবং ভূপৃষ্ঠস্থ উভয় পানিই আজ বিষাক্ত এবং বর্জ্য পানিতে পরিণত হয়। কলকারখানার উচ্ছিষ্ট পানি কী পরিমাণ বর্জ্য পানি তৈরি করে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ। এছাড়াও কলকারখানা সংলগ্ন অসংখ্য জলাশয়ও আজ বর্জ্য পানিতে পরিণত হয়।
পানি বর্জ্য, নোংরা, অপচয় কিংবা অপব্যবহার হয় আমাদের দৈনন্দিন কাজের মাধ্যমেই। কেন আমরা আমাদের অমূল্য এবং স্বাতন্ত্র্য এই সম্পদকে বর্জ্যে পরিণত করছি- সেটি আজ ভাবনার বিষয়। আমাদের টেকসই পৃথিবীর জন্য, দীর্ঘস্থায়ী ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আমাদের এই স্বল্প সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে। পানি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য আমাদের দু’টি কাজ করতে হবে। প্রথমত, পানির অপচয় এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার কমাতে হবে; যেন পানি কম পরিমাণে বর্জ্য পনিতে পরিণত হয়। আর দ্বিতীয়তঃ বর্জ্য পানিকে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পুনঃব্যবহারের উপযোগি করে তুলতে হবে।
বর্জ্য পানিকে সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ এবং সম্ভবনা প্রচুর। বর্জ্য পানির নিরাপদ ব্যবস্থাপনার জন্য খুব বেশি অর্থের প্রয়োজন পড়ে না। পাশাপাশি এই বর্জ্য পানি ব্যবহার বেশ টেকসই এবং শক্তি, পুিষ্ট ও নানা রকম উপাদানের উৎস। অনেকেই ভাবতে পারে বর্জ্য বা নোংরা পানিকে পুনরায় ব্যবহার করে টাকা নষ্ট করার কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু মানুষের সুস্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং টেকসই পরিবেশের নিরীক্ষে এই টাকার পরিমাণ কিছুই না। পাশাপাশি, বর্জ্য পানি ব্যবস্থাপনা নতুন নতুন ব্যবসায়িক ক্ষেত্র তৈরি করবে, যা হতে পারে সবুজ পৃথিবীর সবুজ পেশা।
ছবিগুলো ইন্টারনেট এর মুক্ত সোর্স থেকে সংগৃহীত
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়- www.barciknews.com এ 

ক্ষুদ্র খামার এর বৈশিষ্ট্য

সমসাময়িক সময়ে কৃষি ক্ষেত্রে লাখ টাকার প্রশ্ন হচ্ছে-আমাদের কি চাই; বৃহৎ (বড়) খামার না ক্ষুদ্র (ছোট) খামার? আমরা কোন ধরনের খামারকে সমর্থন করবো? কোন ধরনের খামারের দিকে ধাবিত হবো? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরের আগে কোনটাকে বড় খামার এবং কোনটাকে ক্ষুদ্র খামার বলবো; সে সম্পর্কে আলোকপাত করা জরুরি।
ক্ষুদ্র কিংবা বড় খামার বলতেই আমাদের মাথায় প্রথমেই আসে জমির পরিমাণ এর বিষয়টি। কিন্তু ক্ষুদ্র খামারকে জমির পরিমাণ বা আয়তন দিয়ে বোঝানো বেশ কঠিন। কেননা ভৌগলিকভাবে প্রতিটি দেশ কিংবা এলাকার জমির ধরন এবং গড়ন যেমন ভিন্ন। তেমনি সকলদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব একই নয়। তাই প্রতিটি দেশের খামারের আয়তন ভিন্ন হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র খামারের আয়তন যদি হয় এক একর (প্রায় ৩ বিঘা) তাহলে আমেরিকার ক্ষুদ্র খামারের আয়তন হবে কমপক্ষে ২০০ একর (প্রায় ৬০০ বিঘা)। আমেরিকার কৃষি অধিদপ্তর এর তথ্য মতে, ক্ষুদ্র খামার এর গড় আয়তন ২৩১ একর, মাঝারি খামার এর গড় আয়তন ১৪২১ একর এবং বড় খামারের আয়তন গড় আয়তন ২০৮৬ একর। এই হিসাব বাংলাদেশসহ অন্যান্য তৃতীয় বিশ্ব বা দক্ষিণাংশের কোন দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। তাই ক্ষুদ্র খামারকে চিনতে গেলে খামার এর আয়তন ছাড়াও অন্যান্য বিষয়গুলোকে বিবেচনা করতে হবে।

তবুও সাধারণীকরণ করার জন্য ক্ষুদ্র খামারের একটা নির্দিষ্ট আয়তন নির্ধারণ করতে হবে। নিচের তথ্য থেকে বুঝতে সুবধিা হবে ক্ষুদ্র খামারের আয়তন কতটুকু হয়। তার আগে বলে রাখা ভালো যে, পৃথিবীর অর্থনৈতিক কাঠামো অনুযায়ী সমগ্র পৃথিবীকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা:
১)    উন্নত বিশ্ব বা উত্তরাংশ: যা পৃথিবীর ধনী দেশগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব কম। শিল্প, প্রযুক্তি, অবকাঠামোসহ অন্যান্য দিক দিয়ে এগিয়ে।
২)    অনুন্নত বিশ্ব বা দক্ষিনাংশ: যা মূলত পৃথিবীর গরীব (!), দূর্ভিক্ষ (!), দূর্যোগ (!) পীড়িত দেশগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি এখনো টিকে আছে। এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব উত্তরাংশের চেয়ে অনেক অনেকগুণ বেশি। আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং এশিয়া মহাদেশের অধিকাংশ দেশই এই অংশের অর্ন্তভূক্ত। এই অংশকে কখনো তৃতীয় বিশ্বও বলা হয়ে থাকে।
(বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে এই বিভাজন কোন ভৌগলিক বিভাজন নয়। বরং অর্থনৈতিক বা মনস্তাত্বিক বিভাজন। তাই পৃথিবীর দক্ষিনাংশের অনেক দেশই উত্তরাংশের প্রতিনিধিত্ব করে।)

আফ্রিকার যে সমস্ত ক্ষুদ্র খামার রয়েছে তার গড় আয়তন ৫ একর। এশিয়ার ক্ষুদ্র খামারের গড় আয়তন ৫ একরের কম। আর দক্ষিণ আমেরিকার ক্ষুদ্র খামারের গড় আয়তন ৪.৫ একর। সুতরাং আমেরিকা বা উন্নত বিশ্বকে বাদ দিলে বাকি পৃথিবীর ক্ষুদ্র খামারের গড় আয়তন ৫ একরের বেশি নয়। তাই ক্ষুদ্র খামারের আয়তন কোনভাবেই ৫ একর বা ১৫ বিঘার বেশি হবে না। এখানে একটি বিষয় সুনির্দিষ্ট করা জরুরি যে, এই আয়তন বলতে একটি খামারের আয়তনকে বোঝাচ্ছে না। বরং একজন কৃষক বা একটি কৃষি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে মোট জমির পরিমাণকে বোঝানো হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের একজন কৃষকের যদি ৬টি ক্ষুদ্র খামার (কৃষি জমি) থাকে যার প্রত্যেকটির গড় আয়তন ৪.৫ একর এবং মোট জমির পরিমাণ ২৭ একর। তাহলে তাকে কি ক্ষুদ্র কৃষক বলা যাবে ? আর তার নিয়ন্ত্রণে থাকা খামারগুলো কি ক্ষুদ্র খামারের প্রতিনিধিত্ব করবে? কখনোই না। অন্যদিকে অন্য একজন কৃষকের ৬টি খামার আছে। যার আয়তন যথাক্রমে ২ একর, ০.৪ একর, ১.২ একর, ০.৭ একর, ০.৩ একর  এবং ০.৪ একর। এই ৬টি খামারের মোট আয়তন ৫ একর। আর তাই ২য় কৃষক ক্ষুদ্র কৃষক এবং তার নিয়ন্ত্রণাধীন খামারগুলো ক্ষুদ্র খামারকে প্রতিনিধিত্বশীল হবে।
উপরের আলোচনা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, ক্ষুদ্র খামারের আয়তন কোনভাবেই ৫ একর এর বেশি হবে না। কিন্তু আরো কিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করেছে। যেমন ক্ষুদ্র খামার জমির আয়তন দিয়ে নয়। বরং একজন কৃষক বা কৃষক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা মোট জমির পরিমাণ। আর তাই ক্ষুদ্র খামার বলতে শুধু জমির পরিমাণ দিয়ে চেনা যাবে না। এর সাথে আরো কিছু বিষয় জড়িত।

ক্ষুদ্র খামার এর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জমির মালিকানা। জমির মালিকানা কার হবে? ক্ষুদ্র খামার বলতে বোঝাচ্ছি যেখানে খামারের শ্রম, জ্ঞান, সময়, খামার ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি যে ব্যক্তি ব্যয় করেন তিনিই ক্ষুদ্র খামারের মালিক (কোন কোন ক্ষেত্রে জমির মালিকানা তার না থাকলেও নিয়ন্ত্রণ তার হাতে থাকে)। পক্ষান্তরে বড় খামারের মালিকের কৃষি কাজের প্রাথমিক বিষয়গুলোর সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকে না বললেই চলে। আরা যারা সেই খামারে কৃষি কাজ করেন তাদেরকে কৃষক না বলে কৃষি শ্রমিক বলাই ভালো। বাংলাদেশ সহ দক্ষিণাংশের অনেক কৃষক আছে যাদের নিজস্ব জমি নেই। যাদেরকে আমরা ভূমিহীন কৃষক বা বর্গাচাষী কৃষক বলি। অন্যদিকে দক্ষিণাংশের অনেক আদিবাসী কৃষক রয়েছে যাদের জমি ব্যক্তি মালিকানায় থাকে না। সেক্ষেত্রে এই সমস্ত কৃষক এর নিয়ন্ত্রণে থাকা খামারগুলোকে কী বলা হবে? হ্যাঁ ভূমিহীন কৃষক, বর্গাচাষী এবং আদিবাসী কৃষকের খামারগুলোও ক্ষুদ্র খামারের অর্ন্তভূক্ত হবে। বর্গা বা লিজকৃত খামার এর ক্ষেত্রে শর্ত থাকে যে জমির মালিককে যেন কৃষক চিনতে পারে এবং তার সাথে যেন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকে। ক্ষুদ্র খামারের জমির মালিকানা কখনোই কোন কোম্পানি বা কর্পোরেশন এর হাতে থাকবে না। কৃষক জমির মালিককে যেন ব্যক্তিগতভাবে চিনতে পারে এবং উভয়ের সাথে একটি ‘প্যাট্রন-ক্লাইন্ট’ সম্পর্ক থাকবে।

ক্ষুদ্র খামারের ক্ষেত্রে তৃতীয় বিষয় হচ্ছে খামারের উদ্দেশ্য। অর্থাৎ খামারের উৎপাদিত শস্য বা ফসল কী উদ্দেশ্যে উৎপাদন করা হচ্ছে। এই উদ্দেশ্য কোনভাবেই ব্যবসায়িক হবে না। খামার থেকে উৎপাদিত পণ্য দিয়ে লাভ কিংবা মুনাফা করা প্রধান উদ্দেশ্য হবে না। পারিবারিক চাহিদা মেটানোই হবে মূখ্য উদ্দেশ্য। পারিবারিক চাহিদা মেটানোর পরে উদ্বৃত্ত অংশ বিক্রি করতে পারে- পারিবারিক অন্যান্য আনুষঙ্গিক চাহিদা পূরণ করার জন্য। এক্ষেত্রেও রয়েছে একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা। আমেরিকার কৃষি অধিদপ্তর এর মতে, যে খামার থেকে বাৎসরিক লাভ বা মুনাফা ৮০ হাজার টাকা থেকে ২ কোটি টাকার বেশি হবে না। এমন খামারকেই ক্ষুদ্র খামার বলা হবে। এই টাকার পরিমাণও দেশ এবং এলাকাভেদে ভিন্ন হবে। তবে ক্ষুদ্র খামারের কৃষক কার কাছে তাদের কৃষিপণ্য বিক্রি করবে সেটি সুনির্দিষ্ট করা যায়। ক্ষুদ্র খামারের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি ভোক্তার কাছে বিক্রি করে বা করে থাকে। কোন ব্যবসায়ী, মধ্যস্বত্ত্বভোগী বা সুপার মার্কেটে এর কাছে বিক্রি করে না।
ক্ষুদ্র খামারের কৃষক হয় প্রধানত নারী এবং প্রবীণরাই। এরা শখে কিংবা কৃষির প্রতি ভালোবাসার জায়গা থেকে কৃষিকাজ করে থাকে। ক্ষুদ্র খামারের সাথে পরিবারের সকল সদস্যের শ্রমঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় ফসলের এক অভয়ারণ্য হিসেবে বিবেচিত হয় ক্ষুদ্র খামারগুলো। কৃষির সাথে সাথেই প্রাণী সম্পদ (হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল প্রভৃতি) এবং মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা ক্ষুদ্র খামারের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান।
সবশেষে ক্ষুদ্র খামারে কোন ধরনের জিএমও বা একক প্রজাতির শস্য উৎপাদন করে না। পাশাপাশি, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহার করা হয় স্বল্পমাত্রায় বা হয় না বললেই চলে। কোম্পানির বীজ ব্যবহার করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের সংরক্ষণে পরবর্তী মৌসুমের জন্য বীজ থাকে।
ক্ষুদ্র খামারগুলোর প্রাণ-প্রকৃতি আর জ্ঞানে সমৃদ্ধ হলেও সম্পদের (রিসোর্স) দিক দিয়ে একেবারেই তলানিতে। প্রযুক্তির ব্যবহার হয় একবারেই প্রান্তিক পর্যায়ের। বাজার এবং কোম্পানি নির্ভরশীলতা তুলনামুলক কম থাকে।
এই হলো অনুন্নত বা পৃথিবীর দক্ষিণাংশের ক্ষুদ্র খামারের বৈশিষ্ট্য। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য যে খামারের থাকবে না। তা অবশ্যই বড় খামার। আশা করি এই বৈশিষ্ট্যের আলোকে আমরা খুব সহজে চিহ্নিত করতে পারবো কোনটি ক্ষুদ্র আর কোনটি বড় খামার।
এখন আসি শুরুর প্রশ্নে? আমরা কি চাই- ক্ষুদ্র খামার না বৃহৎ খামার? সেটি পাঠকের কাছেই ছুড়ে দিলাম। আমরা দুটি খামারকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেই বিবেচনা করবো কোনটি আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রাণ-প্রকৃতি, প্রজন্ম এবং পৃথিবীর জন্য জরুরি। টেকসই উন্নয়নের জন্য আমরা কোন ধরনের খামার বেছে নেবো। আমিও ভাবতে থাকি। অন্য কোন লেখায় সেটি নিয়ে আলোকপাত করার ইচ্ছা রইল।

ক্ষুদ্র কৃষকের ক্ষুদ্র খামার : টেকসই, পরিবেশবান্ধব এবং খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ

ইউরোপ কিংবা আমেরিকা বা উন্নত বিশ্বের যে কোন দেশ থেকে কোন ব্যক্তি যদি বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হন এবং কোন কৃষকের সাথে কথা বলেন- তখন স্বভাবত একটি প্রশ্ন সব সময় করে থাকেন- আপনার জমির পরিমাণ কত? বা কতটুকু জমি চাষ করেন। উত্তর শুনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা বেশ অবাক হয় এতো কম পরিমাণ জমি নিয়ে একটি খামার হতে পারে এটা তাদের ভাবনাতেই আসে না!
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক কৃষকের জমির পরিমাণ বৈশ্বিক কৃষিব্যবস্থার বিচারে একবারে স্বল্প। শুধু বাংলাদেশ নয় দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার অধিকাংশ ক্ষুদ্র কৃষকের জমির পরিমাণ একবারেই নগন্য। তবুও তারা তাদের পারিবারিক খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে সমাজ, দেশ এমনকি পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদায় ধারাবাহিকভাবে অবদান রাখছেন।

বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিদ্যমান চাষযোগ্য কৃষিজমি বা শস্যভূমি নিয়ে সারা পৃথিবীতে ধারাবাহিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এই সমস্যা শুধু ৭০০ কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য নয়। বরং সারা পৃথিবীতে দিনকে দিন বৃদ্ধি পাওয়া জৈব তেলের (biofuels) চাহিদাও এর মধ্যে অর্ন্তভুক্ত। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- এই খাদ্য এবং জৈব তেলের চাহিদা অতি অবশ্যই এমন একটি পরিবেশবান্ধব উপায়ে করতে হবে- যেন সেটি টেকসই হয়। কৃষি কার্যক্রম যেন প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে আহরিত রাসায়নিক পদার্থের সর্বনিম্ন ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাণবৈচিত্র্যকে সংরক্ষণ করার পাশাপাশি গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমণও কমাবে। পাশাপাশি এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ যেন সারা পৃথিবীর লাখ লাখ কৃষকের কাছে লাভজনক কাজ হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে- সে বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে একটি পন্থাই হতে পারে সমাধান। আর তা হচ্ছে ছোট ছোট কৃষি খামার।

পৃথিবীর ১.৫ বিলিয়ন হেক্টর চাষযোগ্য জমির মধ্যে ৯১ শতাংশ বছরব্যাপী আবাদ করা হয়। বেশিরভাগ চাষযোগ্য জমিতে মনোকালচারস গম, ধান, ভুট্টা, সূতা এবং সয়াবিন চাষ করা হয়। এটি করা হয় বড় বড় খামারে। যা ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং ব্যাপক পরিমাণ সেচের উপর নির্ভরশীল। এই চাষাবাদের ফলে আমাদের বিশাল পরিমাণ বন এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উদ্ভিদ (অচাষকৃত উদ্ভিদ) প্রজাতি ধ্বংস হয়েছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এসে চাষাবাদ ব্যবস্থার এক প্রজাতিকরণ পরিবেশের ওপর নেবিাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। এর থেকে উদ্ভূত প্রধান প্রধান প্রতিবেশগত দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের (climate change) ফলে পরিবর্তিত প্রতিবেশে শস্যের টিকে থাকার ক্ষমতা ক্রমশ কমে যাচ্ছে।
একক প্রজাতির (mono culture) শস্য অল্প সংখ্যক বৃহৎ খামারে চাষ করা হয়। কৃষকের জন্য এটি ক্ষণিকের অর্থনৈতিক লাভ বয়ে আনলেও দীর্ঘ মেয়াদে একক প্রজাতির শস্য বাস্তুসংস্থানের অনুকূল নয়। বরঞ্চ অত্যন্ত স্বল্প প্রজাতির চাষাবাদ বিশ্ব খাদ্য উৎপাদনকে বড় ধরণের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে এটি স্থানীয় প্রজাতির ধ্বংসের মাধ্যমে সামাজিক এবং পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং দীর্ঘমেয়াদে এটি শস্য প্রজাতি বিলুপ্তির মাধ্যমে পরিবেশের চরম ক্ষতি (যেমন- বাস্তুসংস্থানের ক্ষতি, দারিদ্র্য, ক্ষুধা এমনকি দূর্ভিক্ষও) বয়ে নিয়ে আসছে।
একবিংশ শতকের প্রথম দশক শেষ হওয়ার পূর্বেই মানুষ জীবাশ্ম-জ্বালানিনির্ভর, পুঁজিনির্ভর শিল্পভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থার তাৎক্ষণিক প্রভাব উপলব্ধি করেছে যে, এটি বৈশ্বিক খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য যথোপযুক্ত নয়। তেলের মূল্যবৃদ্ধি অনিবার্যভাবে খাদ্য উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্যের মূল্যও বৃদ্ধি করছে।
একবছর পূর্বে ১০০ টাকায় যে পরিমাণ খাদ্য পাওয়া যেত। বর্তমান সময়ে তার চেয়ে ৩০ শতাংশ কম খাদ্য পাওয়া যায়। এই ধরনের চিত্র তেলসহ অনান্য উপকরণ ক্রয় করার ক্ষেত্রেও দেখা যায়। পরিবেশ বিপর্যয় কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের (climate change) ফলে এই অবস্থা দিনে দিনে আরও জটিল আকার ধারণ করছে। খরা, বন্যা এবং অন্যান্য অনির্দিষ্ট অপ্রত্যাশিত আবহাওয়ার ফলে শস্য ভূমিও হ্রাস পাচ্ছে।

জৈব তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং সংকরায়িত শস্যের ব্যবসায়িক লাভের জন্য আবাদী জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। একক প্রজাতির উদ্ভিদের ব্যাপক চাষাবাদের প্রেক্ষিতে বাস্তুসংস্থানকে আরও বেশি ক্ষতি করা হচ্ছে। এছাড়াও শিল্পনির্ভর কৃষি প্রকৃতিতে নিঃসৃত গ্রীন হাউস গ্যাসের এক চতুর্থাংশ গ্রীন হাউস গ্যাসও নির্গমন করছে। গ্রীন হাউস গ্যাস সমূহের মধ্যে শিল্পভিত্তিক কৃষি প্রধানত মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইড নির্গমণ করছে। বর্তমান সময়ের অর্থনৈতিক প্যারাডাইম কর্তৃক এই ধরণের আধিপত্যশীল ব্যবস্থা বেশিদিন টিকে থাকবে না।
আমাদের প্রজন্মের জন্য বর্তমান সময়কার চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থার স্থানান্তর ঘটানোর মাধ্যমে শিল্পভিত্তিক কৃষিকে টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব কৃষিতে স্থানান্তর করা। আমাদের অন্য একটি বিকল্প কৃষি নির্ভর উন্নয়ন প্যারাডাইম দরকার। যে কৃষি আমাদেরকে টেকসই প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য সামাজিকভাবে উদ্বূদ্ধ করবে। সৌভাগ্যবশত, বর্তমানে এমন হাজারো নতুন এবং বিকল্প উদ্যোগ সারা পৃথিবীতে চর্চা হচ্ছে, যা আমাদের পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানের অনুকূল। আর তেমন একটি চর্চা হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষি খামার। যা  ক্ষুদ্র কৃষককে সংরক্ষণের মাধ্যমে জীবিকার নিশ্চয়তা প্রদান করে। পাশাপাশি, উৎপাদন প্রক্রিয়া অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত, নিরাপদ, বৈচিত্র্যময় খাদ্যের যোগানদার, বণ্টনের স্থানীয়করণ এবং ব্যবসা ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রেও সুবিধাজনক।

বাস্তুসংস্থানের অনুকূল বেশিরভাগ টেকসই কাঠামো আমাদের ঐতিহ্যবাহী কৃষিব্যবস্থায় বিদ্যমান ছিল। এ ধরণের লক্ষাধিক উদাহরণ এখনো পর্যন্ত স্থানীয় গ্রামীণ কৃষিব্যবস্থায় বিদ্যমান। এই ধরণের ঐতিহ্যবাহী কৃষিব্যবস্থার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খামার শিল্পায়নভিত্তিক কৃষির জন্যও ফলপ্রসূ হবে যদি তারা প্রাণবৈচিত্র্যকে সংরক্ষণ করতে আগ্রহী হয় এবং রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার ছাড়াই বাৎসরিক উৎপাদন প্রক্রিয়াকে টেকসই করার মাধ্যমে। এই ধরণের কৃষি ব্যবস্থা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পৃথিবীর খাদ্য চাহিদার যোগান দিয়ে এসেছে। যেখানে লোকায়ত জ্ঞানের ব্যবহারের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বাস্তুতন্ত্রের সমন্বয় ও সংরক্ষণ করে এসেছে।

আন্তর্জাতিক কৃষক আন্দোলন, যা লা ভায়া ক্যামপেসিনা (via campesina) নামে পরিচিত। এই আন্দোলন দৃঢ় যুক্তি দেখায় যে, একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের খাদ্য চাহিদায় স্বনির্ভর হওয়ার জন্য ক্ষুদ্র কৃষক এবং তাদের ক্ষুদ্র খামার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি আরো বিশ্বাস করে যে, জীবিকা, চাকুরি, মানুষ ও অনান্য প্রাণের খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং একই সাথে টেকসই পরিবেশ এর জন্য যে খাদ্য উৎপাদন প্রয়োজন তা ক্ষুদ্র পর্যায়ের কৃষকদের হাতে নিহিত। বিশাল বড় কৃষিভিত্তিক ব্যবসা এবং সুপার মার্কেটের নিয়ন্ত্রণে এটি কখনোই সম্ভব না। রপ্তানিনির্ভর, মুক্ত বাণিজ্য, শিল্প কৃষি কাঠামোর মাধ্যমে যে বড় বড় খামার পরিচালিত হয়- তার মাধ্যমে সম্ভব না। এই চলমান ব্যবস্থা পক্ষান্তরে দারিদ্রকে আরও চরমে নিয়ে যায়, মজুরি কমিয়ে দেয়, গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন বাড়িয়ে দেয়, ক্ষুধা এবং সর্বোপরি পরিবেশের বিপর্যয় ঘটায়। শুধুমাত্র এই ধরণের কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান সময়ের খাদ্য সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব।
গ্রামীণ সামাজিক আন্দোলনসমূহ খাদ্যের স্বনির্ভরতা বা সার্বভৌমত্বের ধারণাকে এবং নব্য উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যকার সম্মিলন ঘটায়। যা বিশ্বাস স্থাপন করে যে, আন্তর্জাতিক ন্যায়সঙ্গত ব্যবসা পৃথিবীর খাদ্য সংকট সমাধান করতে সক্ষম। শুধু তাই নয়,  এটি ভূমি, বীজ, সার, কীটনাশক এবং পানির উপর কৃষকের মালিকানার উপর ও গুরুত্বারোপ করে। এমনকি ক্ষুদ্র খামার ব্যবস্থা স্থানীয় অর্থনীতি, স্থানীয় বাজার, স্থানীয় উৎপাদন-ভোগ চক্র, শক্তি/এনার্জি এবং প্রযুক্তির সার্বভৌমত্ব এবং কৃষক নেটওয়ার্কের উপরও আলোকপাত করে।
ভায়া ক্যামপেসিনা (via campesina) মতো সারা পৃথিবী ব্যাপী আমাদেরেেক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বৈশ্বিক আন্দোলনের মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের জন্য (পৃথিবীর উত্তরাংশ) মানুষের কাছে খাদ্য রাজনীতি ও বাণিজ্যেরে এই নেতিবাচক বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে পৃথিবীর দক্ষিণাংশের (দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকা ) ক্ষুদ্র খামারভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সমর্থন করতে হবে। কারণ এই সমস্ত দেশের ধনীরা দিন দিন সেই সমস্ত ইউনিক খাদ্যের উপর ঝুঁকছে যা দক্ষিণের বাজারজাত অর্গানিক শস্য।
কিন্তু, এই ধরণের যুক্তি কি উত্তরের (উন্নত বিশ্বের) ভোক্তা এবং রাজনীতির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে? নাকি অন্য কোন জোরালো যুক্তির প্রয়োজন? আমাদের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন যে, উত্তরের জনগণের ভালো জীবনমান এবং খাদ্য নিরাপত্তা শুধু নয়; বরং তাদের বাস্তুসংস্থানের সুবিধাও দক্ষিণের ক্ষুদ্র কৃষকের উপর নির্ভরশীল। আসল সত্য এই যে, আফ্রিকা, এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার ক্ষুদ্র খামার ব্যবস্থায় যে ধরণের কার্যাবলী সংঘটিত হয় তা তেলনির্ভর কৃষিব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি মানবিক।  মানুষসহ সকল প্রাণির মঙ্গল এবং উদ্ভিদপ্রজাতির টিকে থাকার সাপেক্ষে বাস্তুতান্ত্রিক সম্পদকে সমৃদ্ধ করছে। আরও সত্য যে, তেল এবং খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ বিপর্যয়, GMO Pollution এবং আধিপত্যশীল কর্পোরেট খাদ্য ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণাংশের ক্ষুদ্র কৃষকের ক্ষুদ্র খামার ব্যবস্থা  প্রাণবৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থানের জন্য একমাত্র অনুকূল কৃষি ব্যবস্থা। যা পরিবর্তিত নতুন বাস্তুতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক চাহিদার প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বকে খাদ্য যোগান দিতে পুরোপুরি সক্ষম।
প্রবন্ধটি Miguel A Altieri এর রচিত Linking Ecologists and Traditional Farmers in the Search for Sustainable Agriculture অনুকরণে লিখিত।

গবেষণা

অভিজিৎ রায়, সহকারী অধ্যপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
গবেষণা কি?
সাধারণ অর্থে গবেষণা জ্ঞানের অনুসন্ধানের অন্তর্ভুক্ত।
গবেষণাকে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর নির্দিষ্ট তথ্য লাভের বৈজ্ঞানিক এবং পদ্ধতিগত
অনুসন্ধানও বলা যায়। আসলে
, গবেষণা হল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের একটি শিল্প।
Redman এবং Mory গবেষণাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘‘নতুন জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতিমূলক চেষ্টা
কিছু ব্যক্তিরা মনে করেন গবেষণা একটি ধারা, অজানা থেকে জানার দিকে ধাবিত
একটি গতি। গবেষণা একটি প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম
, এমনকি কৌশলগত ধারণার
ক্ষেত্রে এই টার্মটি ব্যবহার করা উচিত।
Clifford
Woody
এর মতে, ”গবেষণার অন্তর্ভুক্ত হল
সমস্যার সংজ্ঞায়ন ও পুন:সংজ্ঞায়ন
, পূর্বানুমান তৈরি অথবা সম্ভাব্য সমাধানগুলো সংগ্রহ করা, সংগঠন করা ও প্রাপ্ত তথ্যের
মূল্যায়ন করা
; অবরোহ তৈরি করা ও ফলাফলে পৌঁছানো এবং পরিশেষে ফলাফল সাবধানে পরীক্ষা করার
মাধ্যমে সংগঠিত পূর্বানুমানের সাথে খাপ খায় কিনা তা নির্ধারণ করা।
(Kothari 2004:1)
কেন গবেষণা?
  • কিছু সৃজনশীল কাজের
    মধ্য দিয়ে জ্ঞান লব্ধ আনন্দ পাওয়ার ইচ্ছা
    ,
  • সমাজের সেবা করার ইচ্ছা,
  • প্রায়গিকভাবে কোন
    সমস্যার সমাধান খোঁজার ইচ্ছা
    ,
  • একটি গবেষণার ডিগ্রী
    অর্জন এবং ফলাফলসরূপ লাভের ইচ্ছা
    ,
  • শ্রদ্ধাভাজন হওয়ার
    ইচ্ছা
    ,
  • পুরাতনকে খোঁজা এবং
    নতুনকে সনাক্ত করা
    ,
  • জনমত তৈরীর জন্য
    শিক্ষামূলক কার্যক্রম
    ,
  • বিদ্যমান কোন বিষয়ের
    সত্যতা যাচাই করা।
গবেষণার লক্ষ্য কি?
গবেষণার উদ্দেশ্য হল বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া প্রয়োগের মধ্য দিয়ে প্রশ্নগুলোর
উত্তর আবিস্কার করা।গবেষণার মুল লক্ষ্য লুকিয়ে থাকা সত্যকে
,যা এখনও আবিস্কৃত হয়নি তা
খুঁেজ বের করা।যদিও প্রতিটি গবেষণা অধ্যায়নের কিছু নির্দিষ্ট  লক্ষ্য থাকে
,নি¤œ উল্লেখিত ভাগগুলোকে
বিস্তারিতভাবে গবেষণার লক্ষ্য হিসেবে ধরে নিতে পারি-
  • একটি প্রপঞ্চ সর্ম্পকে
    পরিচিতি লাভ করা অথবা তার মধ্য দিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা।
  • একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তি,
    অবস্থা ও দলের
    বৈশিষ্ট্যসমূহের বর্ণনা করা।
  • কোন কিছু ঘটে যাওয়ার
    মাত্রা অথবা তার সাথে সর্ম্পকিত অন্য কিছুকে নির্ধারণ করা।
·        
চলকগুলোর মধ্যে অপরিকল্পিত
সর্ম্পকগুলোকে পুর্বানুমান করার জন্য পরীক্ষা করা।
(Kothari
2004:2)
গবেষণায় মূলত ৮
ধরনের লক্ষ্য হতে পারে-
  • আবিস্কার
  • বর্ণনা
  • বোঝাপড়া
  • ব্যাখ্যা
  • অনুমান
  • পরিবর্তন
  • মূল্যায়ন
  • প্রভাবসমূহ নির্ধারণ
গবেষণা নকশা তৈরী :
একজন গবেষককে বা গবেষক দলকে একটি গবেষণা কর্ম পরিচালনার পূর্বে কিছু
সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়।
গবেষণার তাৎর্পয কি?
  • পরিকল্পনার ক্ষেত্রে
    গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
  • কোন প্রপঞ্চ
    নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দান করতে পারে।
  • সমাজ সংস্কারমূলক কাজে
    ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে।
  • মানুষের মূল্যবোধ,
    অভিমুখীনতা ও
    কুসংস্কারকে দূরীভূত করতে প্রয়োজনীয় ঐক্যমতের ভিত্তি সৃষ্টি করতে পারে।
  • জীবনযাত্রার মান
    বৃদ্ধির জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করতে পারে।
  • প্রযুক্তির বিকাশ,
    গ্রহণ ও
    স্থায়িত্ব প্রদানে সামাজিক সহায়তার ভিত্তি প্রস্তুত করতে পারে।
  • বিজ্ঞানের ও বিশ্বাসের
    সামাজিক প্রভাব
    , প্রতিপত্তি ও দ্বন্দ্বকে মূল্যায়নের মাধ্যমে বিজ্ঞানের দর্শন ও বিজ্ঞানের
    সমাজতত্ত্ব বিষয়ক জ্ঞান বৃদ্ধি করতে পারে।
  • প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মত
    সঠিক ও যথেষ্ট ভবিষ্যতবাণী করতে না পারলেও সীমিত ক্ষেত্রে সংস্কৃতি ও
    পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতবাণী করতে পারে।
সামাজিক গবেষণা:
সামাজিক গবেষণা কি?
সামাজিক গবেষণা বলতে সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণাকে বুঝানো হয়ে
থাকে। সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের বিষয়বস্তু মানুষ
, মানুষের মন, মানুষের সমাজ, মানুষের সংস্কৃতি, মানুষের অর্থনীতি, মানুষের রাজনীতি প্রভৃতি।
মোট কথা মানুষ
, তার আচরণ ও ক্রিয়া, এবং মানুষের সমাজ-সংগঠন সামাজিক বিজ্ঞানীদের সাধারণ বিষয়বস্তু। একারণে সামাজিক
গবেষণা বলতে শুধু সমাজতাত্ত্বিক গবেষনাকে ধরে নেয়া ঠিক নয়। তাছাড়া
, সামাজিক বিজ্ঞানের পদ্ধতি
এবং পদ্ধতিতত্ত্বে যথেষ্ট সাদৃশ্য থাকায় সামাজিক গবেষণা বিষয়ক আলোচনায় সাধারণত
ব্যাপক দৃষ্টিকোণ লক্ষ্য করা যায়। আমরা সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার উপর কোন কোন
ক্ষেত্রে বিশেষ গুর
ত্ব দিলেও এখানে সামাজিক গবেষণা বলতে সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণাকেই বুঝানো হবে।
বলা বাহুল্য
, সামাজিক গবেষণা বলতে সামাজিক বিষয়ের বৈজ্ঞানিক গবেষণাকেই বুঝতে হবে। (মুহাম্মদ
হাসান ইমাম ১৯৯৮:১০৬)
সামাজিক গবেষণার বৈশিষ্ট্য:
সামাজিক গবেষণার কতক বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যদিও একথা বলার অপেক্ষা
রাখে না যে সব প্রাকৃতকি বিজ্ঞানেও অনেকগুলো অভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। নি
¤œ প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো
বর্ণনা করা হল:
  • সামাজিক সমস্যা সমাধানে
    সহায়ক
  • সামাজিক গবেষণা দু ইবা
    ততোধিক চলকের (
    variable) মধ্যে সম্পর্ক
    আবিষ্কার করে
  • সামাজিক অবস্থা
    সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বানী করে
  • সামাজিক গবেষণা বাস্তব
    তথ্য নির্ভর
  • সামাজিক গবেষণা
    ধারাবাহিক ও সুশৃঙ্খল
  • সামাজিক গবেষণা সঠিক
    তত্ত্ব গঠনে ব্যাপ্ত
  • সামাজিক গবেষণা
    বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসরণ করে।
(ড. খুরশিদ আলম ২০০৩:৯২)
সামাজিক গবেষণার প্রকারভেদ:
কোন নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোন সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা বা কোন অজানা
বিষয়ে জানার চেষ্টা করা।  বস্তুত গবেষণাকে
নি
¤œক্ত প্রকারভেদে ভাগ
করা যায়
, যেমন:
  • মৌলিক গবেষণা (Basic or fundamental research)
  • ফলিত গবেষণা (Applied research)
  • কার্যোপযোগী গবেষণা (Operational research)
  • মূল্যায়ন গবেষণা (Evaluative research)
  • পরীক্ষনমূলক গবেষণা (Experimental research)
  • জরিপ গবেষণা (Survey research)
  • মাঠপর্যায়ের
    অনুসন্ধানমূলক গবেষণা
    (Field investigative research)
(ড. খুরশিদ আলম ২০০৩:৯৬)
মৌলিক গবেষণা:
যে গবেষণার দ্বারা কোন তত্ত্বের ও পূর্বানুমানের উন্নয়ন ও পরীক্ষা করা হয়
অনুসন্ধানকারীর জ্ঞানের স্থান পূরণের উদ্দেশ্যে এবং যার কিনা ভবিষ্যতে সামাজিক
প্রায়োগিক দিক থাকবে
, কিন্তু বর্তমানের সমস্যা সমাধানের কোন প্রায়গিক দিক নেই তাই মৌলিক গবেষণা। (ড.
খুরশিদ আলম ২০০৩:৯৭) এক কথায় বললে যে গবেষণার দ্বারা জ্ঞানের সংগ্রহ হয় জ্ঞান
লাভের উদ্দেশ্যে তাই মৌলিক গবেষণা।
(Kothari
2004:3)
বস্তুত মৌলিক
গবেষণা নি
¤œবর্ণিত দুটি কাজ সম্পন্ন করে।
১.    নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার
২.    বিদ্যমান তত্ত্বের উন্নয়ন
ফলিত গবেষণা:
ফলিত গবেষণা হচ্ছে সেই গবেষণা যার দ্বারা সামাজিক সমস্যা সমাধান সম্ভব,
যে সমস্যাগুলো
সমসাময়িক উদ্বিগ্নের বিষয়। অর্থাৎ ফলিত গবেষণার লক্ষ্যই হচ্ছে সেই সকল সমস্যা
সমাধান পাওয়া যা কিনা কোন সমাজ বা প্রতিষ্ঠানে ঘটছে।
(Kothari 2004:3) তাত্ত্বিক গবেষণা ও ফলিত
গবেষনা পরষ্পর সম্পর্কিত
, কারণ তাত্ত্বিক গবেষণা ফলিত গবেষণার পথপ্রদর্শক।
কার্যোপযোগী গবেষণা:
কার্যোপযোগী গবেষণা হচ্ছে ক্ষুদ্র পরিসরের কোন সমস্যা সমাধান ও যৌক্তিক
সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যে গবেষণা পরিচালিত হয়। ফলিত গবেষণার সাথে এর মৌলিক
পার্থক্য হল কার্যোপযোগী গবেষণা সম্পাদিত হয় ক্ষুদ্র পর্যায়ে আর ফলিত গবেষণা
সম্পাদিত হয় বৃহৎ পর্যায়ে।  (ড. খুরশিদ আলম
২০০৩:৯৮)
মূল্যায়ন গবেষণা:
মূল্যায়ন গবেষণা পরিচালিত হয় কোন কিছুকে যেমন উন্নয়ন কর্মসূচী ও প্রকল্পকে
মূল্যায়ন করার উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ যে গবেষণা দ্বারা কোন প্রকল্পের কার্যকারিতা দেখা
হয় তাই মূল্যায়ন গবেষণা।
পরীক্ষণমূলক গবেষণা:
পরীক্ষণমূলক গবেষণা হচ্ছে একটি স্বাধীন চলককে নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে,
যখন অন্যান্য অধীন চলকের
উপর এর প্রভাব দেখা হয়। আর এখানে নিয়ন্ত্রণে রাখার অর্থ হচ্ছে ঐ চলকটিকে ধ্র
ব ধরা।
জরিপ গবেষণা:
জরিপ গবেষণা হচ্ছে কোন নির্দিষ্ট সম্প্রদায়, দল বা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন
সমস্যা
, আলোচিত বিষয় ও ঘটনার
বিশ্লেষণ। আর সেই বিষয়গুলো হতে পারে কখনো মতামত যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আবার কখনো
সমস্যা ধরণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে।
মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধানমূলক গবেষণা:
গবেষক যখন কোন সমস্যা বা বিষয়কে নিয়ে জানতে গিয়ে সরেজমিনে অনুসন্ধান চালান তখন
তা মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধানমূলক গবেষণা হয়।
(ড. খুরশিদ আলম ২০০৩:৯৮-১০১)
গবেষণার অন্যান্য শ্রেণী বিভাগ:
উপরে আলোচিত গবেষণার প্রকারভেদ ছাড়াও গবেষণাকে আরও শ্রেণীবিভাগে বিভক্ত করা
যায়
, যেমন:
·        
বর্ণনামূলক গবেষণা বনাম
বিশ্লেষণমূলক গবেষণা
(Descriptive
vs. Analytical research
)
·        
গুণগত গবেষণা বনাম পরিমাণগত
গবেষণা
(Qualitative
vs. Quantitative research
)
·        
ধারণাভিত্তিক গবেষণা বনাম
সরেজমিনে গবেষণা
(Conceptual
vs. empirical research
)
বর্ণনামূলক গবেষণা বনাম বিশ্লেষণমূলক গবেষণা:
বর্ণনামূলক গবেষণার দ্বারা বিভিন্ন জরিপ এবং অনুসন্ধান চালানো হয় বিভিন্ন ঝটনা
উৎঘাটনের জন্য। এই গবেষণার লক্ষ্য হল বর্তমানে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে বর্ণনা করা। আর এর
উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল
, এই গবেষণায় গবেষকের চলকের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, কেবলমাত্র বর্ণিত হয় যা
ঘটেছে বা ঘটে চলছে। অন্যদিকে বিশ্লেষণমূলক গবেষণা হচ্ছে  যেখানে আগেই ঘটনা উপস্থাপিত থাকে
, আর এই গবেষণার দ্বারা সেই
ঘটনার সূক্ষ্ম মূল্যায়ন ঘটে।
গুণগত গবেষণা বনাম পরিমাণগত গবেষণা:
গুণগত গবেষণা হচ্ছে যেখানে কোন কিছুর গুণকে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে পরিমাণগত
গবেষণার ভিত্তি হচ্ছে সংখ্যাবাচক পর্যালোচনা। অর্থাৎ সংখ্যাবাচক পর্যালোচনার
মাধ্যমে কোন ঘটনা বা বিষয়কে ব্যাখ্যা করা। যা কিনা গুণগত গবেষণায় গুণকে পর্যালোচনা
করা হয়।
ধারণাভিত্তিক গবেষণা বনাম সরেজমিনে গবেষণা:
ধারণাগত গত গবেষণার সাথে
ভাবনা এবং তত্ত্ব সম্পর্কিত। এই গবেষণা সাধারণত দার্শনিক এবং চিন্তাবীদরা করে
থাকেন
, যার মাধ্যমে তাঁরা
নতুন কোন তত্ত্ব বা বিদ্যমান কোন বিষয়কে ব্যাখ্যা করে থাকেন। অন্যদিকে সরেজমিনে
গবেষণা হচ্ছে পুরোটাই অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করে
, কখনো কোন পদ্ধতি কিংবা
তত্ত্বের উপর নির্ভরশীলতা ছাড়াই। ইহা তথ্য নির্ভর গবেষণা।
(Kothari 2004:3-4)
গবেষণা প্রক্রিয়া:
  • গবেষণা সমস্যার
    সংজ্ঞায়ন
  • সাহিত্য পর্যালোচনা
  • অধ্যায়নের সামগ্রিকতা ও
    একক নির্ধারণ
  • পুর্বানুমানের আকার গঠন
    ও চলক নির্ধারণ
  • গবেষণা কৌশল ও পদ্ধতি
    নির্ধারণ
  • পরিসংখ্যানিক অথবা অন্য
    পদ্ধতি গ্রহণ
  • তথ্য সংগ্রহ
  • তথ্য বিশ্লেষণ
  • ব্যাখ্যা দেওয়া ও
    বিবরণী
    (Report) লেখা
গবেষণা সমস্যার সংজ্ঞায়ন:
সাধারণত গবেষণার সমস্যা হচ্ছে কোন গবেষক তাত্ত্বিক কিংবা বাস্তবিক অভিজ্ঞতার
মধ্যদিয়ে জটিলতায় পড়লে যা সমাধান বা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। আর গবেষণার প্রথম
ধাপই হচ্ছে গবেষণার জন্য সমস্যা নির্ধারণ এবং গবেষণার সমস্যাকে পরিষ্কাররূপে
বর্ণনা করা। আর এই সমস্যা কখনো গবেষকের আগ্রহ থেকে আসে আবার কখনো তত্ত্বের উপরও
নির্ভর করে। আর সমস্যার উপর নির্ভর করে গবেষণার ক্ষেত্র নির্বাচন করেন একজন গবেষক।
সাহিত্য পর্যালোচনা:
গবেষণার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্যেই মূলত  গবেষণায় সাহিত্য পর্যালোচনা করা হয়, কিন্তু তার থেকেও বেশি গুরত্বপূর্ণ একটি কার্যকরী
গবেষণা পদ্ধতি গ্রহণ করা। আর সেক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদপত্র
, সম্মেলনের আলাপ-আলোচনা,
সরকারি প্রতিবেদন,
বই, ইন্টারনেট ইত্যাদি
পর্যালোচনা করা হয়। সাধারণত দুই ধরণের সাহিত্য পর্যালোচনা করা যায়
, যেমন: তত্ত্ব ও ধারণা লব্ধ
সাহিত্য এবং পূর্ব অভিজ্ঞতালব্ধ অধ্যয়নের সাহিত্যসমূহ।
অধ্যায়নের সামগ্রিকতা ও একক নির্ধারণ:
তথ্য সংগ্রহের পূর্বেই আমাদের অধ্যায়নের সামগ্রিকতা ও একক নির্ধারণ করতে হবে।
অধ্যয়নের সামগ্রিকতা নির্ধারণের কারণ হচ্ছে এর মাধ্যমে  বাহ্যিক আকার এবং সামাজিক এককগুলো অধ্যয়ন করা
সম্ভব হবে। যার জন্য করা হয়ে থাকে
, প্রাক-অধ্যয়ন ও নমুনা নির্ধারনের মত বিষয়গুলো।
পুর্বানুমানের আকার গঠন ও চলক নির্ধারণ:
গবেষণার যৌক্তিকতা নির্ধারণের জন্য গবেষণার আপাত ধারণা নির্ধারণ করাই গবেষণার
পূর্বানুমান বলা হয়। আর গবেষণার পূর্বানুমানের উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে গবেষণার
অনুসন্ধানের পথনির্দেশক সরূপ। সাধারণত একটি পূর্বানুমানের কিছু চলক থাকে
, যার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন চলকের
মধ্যে যে সম্পর্ক বিদ্যমান তা দেখা হয়। আর সেই সম্পর্ক কখনো হয় ধণাত্মক
, আবার কখনো ঋণাত্মক ও কখনো বা
শূন্য।
গবেষণা কৌশল ও পদ্ধতি নির্ধারণ:
গবেষকের জানার আগ্রহের জায়গা সম্পর্কে অবগত হলে, গবেষকের পরবর্তি যে চিন্তা
আসে তা হল কি করে আগ্রহের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। আর তখনই প্রয়োজন হয়ে পরে একজন
গবেষককে গবেষণার কৌশল ও পদ্ধতি নির্ধারণের। উদাহরণ সরূপ: গবেষণার জন্য সামগ্রিক
তথ্য আনয়নের জন্য প্রশ্ন পত্রের সরূপ তৈরি থেকে শুর
করে সাক্ষাৎকার গ্রহণের নানা
কৌশল নির্ধারণ করা ইত্যাদি।
পরিসংখ্যানিক অথবা অন্য পদ্ধতি গ্রহণ:
তথ্য সংগ্রহ:
কখনো সামাজিক গবেষণায় দরকার হয়ে পড়ে ভিন্ন সম্প্রদায়কে জানা, সেক্ষেত্রে গবেষককে অনেক
প্রস্তুতি নিতে হয় ভিন্ন সমাজে ঢুকার জন্য। তারপর গবেষক তথ্য সংগ্রহ শুর
করেন, আর সেই তথ্য হয় দুই ধরণের।
যেমন
, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক
তথ্য। প্রাথমিক তথ্য হচ্ছে যা গবেষক তার গবেষণা ক্ষেত্র থেকে সংগ্রহ করেন
, আর মাধ্যমিক তথ্য হচ্ছে যা
গবেষক কোন মাধ্যমিক উৎস (বই
, ইন্টারনেট..) থেকে সংগ্রহ করেন।
তথ্য বিশ্লেষণ:
তথ্য সংগ্রহের পর একজন গবেষক তথ্যের বিশ্লেষণ করে থাকেন। আর তখন পড়ফরহম, ঃধনঁষধঃরড়হ এর মত কৌশলগুলো
অবলম্বন করেন একজন গবেষক তথ্যকে বিশ্লেষণ করার উদ্দেশ্যে। মাঝে মাঝে তথ্য সংগ্রহের
ধরণই ঠিক করে দেয় যে তথ্য বিশ্লেষণ কিরূপ হবে।
ব্যাখ্যা দেওয়া ও বিবরণী (Report)
লেখা:
গবেষণার ব্যাখ্যা বা বিবরণী লেখার সময় গবেষককে গবেষণার নৈতিকতার ব্যাপারে
খেয়াল রাখতে হয়
, আরও বিশেষ করে যখন গবেষণাটি হয় কোন স্পর্শকাতর বিষয়কে নিয়ে। যখন কোন সামাজিক
বাস্তবতা উৎঘাটনে কোন গবেষক তাঁর গবেষণা করেন
, তখন উচিত সেই সমাজের গোপনীয়
বিষয় নিয়ে খেলা না করা
, কারণ সেই জনগোষ্ঠী কেবলমাত্র গবেষকের কাছে অধ্যায়নের বিষয়বস্তু নয় তার থেকেও
বেশি কিছু।
গবেষণার নৈতিকতা:
গবেষণার নৈতিকতার নিয়ম হিসাবে নিচে আলোচিত বিষয়গুলোকে ধরা হয়,
  • স্বেচ্ছামূলক অংশগ্রহণ।
    গবেষণায় অংশগ্রহণ কখনোই জোড় করে করানো যাবে না
    , এবং যদি কেউ অংশগ্রহণ
    করতেও আগ্রহী হয় তাহলে তাকে জানাতে তার গবেষণা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার
    অধিকারও তার আছে।
  • গবেষণায়
    অংশগ্রহণকারীদের জানানো। যারা গবেষণায় অংমগ্রহণ করবে তাদের অবশ্যই গবেষণার
    প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্যে সম্পর্কে জানবে। তাছাড়া গবেষণায় যে পদ্ধতি ব্যবহার করা
    হচ্ছে
    , কেন তাদের এই গবেষণার সাথে জড়িত করা হচ্ছে এবং গবেষণার ফলাফল ব্যবহারের
    উদ্দ্যেশ্য সম্পর্কে তাদের জানানো হবে।
  • গবেষণায় অংশগ্রহণ কারীর
    ধারণার অবমূল্যায়ন না করা। গবেষণায় অবশ্যই অংশগ্রহণকারীর দেওয়া তথ্যের
    গোপনীয়তা রক্ষ্যা করতে হবে যেন তথ্যের অবমূল্যায়ন না হয়।

গবেষণায় শুদ্ধতা। গবেষণার অবশ্যই একটা মান থাকবে যা গবেষণাকে অসততা থেকে

‘কৃষি’ কেন গুরুত্বপূর্ণ

বারসিক এর সাথে আমার যাত্রা ২০১১ সাল থেকে। প্রথম বার ফেলোশিপ এর মাধ্যমে দ্বিতীয়বার গবেষণা সহকারী হিসেবে ২০১২ সালে এবং সব শেষে ২০১৪ সালে কর্মী হিসেবে। প্রতিবার যখনই জানার চেষ্টা করেছি বারসিক কী নিয়ে কাজ করে। তখন বারবারই সবকিছু ছাঁপিয়ে প্রধান কাজ হিসেবে দেখা দেয় ‘কৃষি’ র নাম। আবার আমি নিজেও যখন অন্য কাউকে বোঝাতে যাই তখন বোঝানোর শেষে সেই ব্যক্তি বলে ওঠেন, ‘‘ও আপনারা কৃষি নিয়ে কাজ করেন”। কিংবা কখনো বোঝানোর কষ্ট না করে বলি কৃষি নিয়ে কাজ করি। কিন্তু, বারবারই মনে হয়েছে, শুধু কৃষি দিয়ে বারসিক কে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিনিধিত্ব করা হয় কি? এই প্রশ্নের উত্তর অনেক দিন খুঁজেছি। তবে মন ভরেনি। অবশেষে, গত বছর বারসিক রামেশ্বরপুর রিসোর্স সেন্টার এ আমি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যায়ল এর নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক অভিজিৎ রায় এবং বারসিক এর সমন্বয়কারী সৈয়দ আলী বিশ্বাস এর সাথে একটি আড্ডার আলোচনা থেকে এর আংশিক উত্তর খুজে পাই। সেদিনকার সেই বোঝাপড়া আমি বারসিক পরিবার এবং শুভাকাংখিদের সাথে শেয়ার করতে আগ্রহ প্রকাশ করছি।
বারসিক ২০০১ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রধানত যে কাজটা করে সেটা হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদকে মানুষ কীভাবে জীবনধারনের জন্য চর্চার মধ্য দিয়ে সেটাকে (প্রাকৃতিক সম্পদ) সংরক্ষণ করে। বারসিক তার এই ধারণাগত জায়গাকে স্পষ্ট করার জন্য- মানুষকে বোঝার জন্য যে, মানুষ কীভাবে প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে তার জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করছে। এই ৩ বছর মানুষের সেই সমস্ত কৌশল বোঝার চেষ্টা ও ডকুমেন্টেশন করেছে।
এই ৩ বছরের কাজের মধ্য দিয়ে প্রধানত ৩টি বিষয়কে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। যথা:
১)     প্রাকৃতিক সম্পদ,
২)     চর্চা ও ব্যবহার এবং
৩)     সংরক্ষণ।
এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে পারষ্পারিক সম্পর্ক হচ্ছে কৃষি। আর কৃষির সাথে এই সম্পর্ক হচ্ছে জ্ঞান উৎপাদনের সর্ম্পক।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই কৃষি বা কৃষকের জ্ঞান বা সাধারণ জনগণের জ্ঞান কেন বারসিক এর কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ? কেননা আধুনিক জ্ঞান যেখানে কৃষি পন্যের উৎপাদনকে বৃদ্ধি করে। পাশাপাশি যে কোন সমস্যা সমাধানে আধুনিক জ্ঞান অনেক বেশি কার্যপোযোগি; সেখানে কেন বারসিক এত বেশি সাধারণ মানুষের জ্ঞানকে প্রাধান্য দিচ্ছে?
আমরা সবসময় পড়ে এসেছি, শিখে এসেছি এবং জেনে এসেছি যে, কৃষি হচ্ছে উৎপাদন (প্রোডাকশন) এর বিষয়, বাণিজ্যিক (মার্কেট) বিষয়, কৃষি হচ্ছে লাভ-ক্ষতির বিষয়। পাশপাশি কৃষিকে সমসাময়িক সময়ে সাধারণীকরণ করা হয় খাদ্য নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে।
কিন্তু বারসিক যখন কৃষকের কাছ থেকে ‘কৃষিকে’ বুঝার চেষ্টা করে তখন দেখা যায় কৃষকের কাছে কৃষি শুধুমাত্র উৎপাদনের বিষয় নয়। এটি একজন কৃষকের কাছে সমগ্র জীবনের বিষয়। কৃষি হচ্ছে সামাজিক বন্ধনের ও সামাজিক সংহতির বিষয়। গ্রামীণ জীবনের পারস্পারিক দ্বন্দ্ব সংঘাত ও সংহতির বিষয়। কেননা কৃষির মধ্যে দিয়েই একটি গ্রামের সম্পর্ক তৈরি হয় এবং বিরাজ করে। একই সাথে কৃষি হচ্ছে পরিবেশ এবং প্রতিবেশীয় বিষয়। এটি কৃষকের কাছে মাটি ও বাস্তুসংস্থান এর বিষয়। একইসাথে এটি কৃষকের কাছে বৈচিত্র্যের বিষয়। বৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখার বিষয়, বৈচিত্র্যের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার বিষয়।
কিন্তু কৃষি যখন একজন উন্নয়ন কর্মী/প্রতিনিধি (এজেন্ট) বা একজন গবেষক যখন উপস্থাপন করে তখন সে নিয়ে আসে লাভ-ক্ষতি, কৃষি উপকরণ এবং খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়গুলো। আর সকল উন্নয়ন এজেন্সী কৃষিকে একইভাবে উপস্থাপন করে। কিন্তু একজন কৃষকের কাছে কৃষির বিষয়টি তার জীবনাদর্শনের সাথে সম্পর্কীত। কৃষক তার কৃষিকে কক্ষনোই ওতোটা সরলীকরণ করে দেখে না। একজন কৃষক যখন তার কৃষিকে তার প্রতিবেশ, তার গ্রাম, তার বৈচিত্র্যময় জীবনযাপনের সাথে আন্তঃসম্পর্ক করে ভাবতে পারে; তখন কোনভাবেই এই কৃষি এবং কৃষকের জ্ঞান উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে না রাখার অবকাশ থাকে না। সুতরাং গ্রামে কাজ করার ক্ষেত্রে এই একটি কারণই যথেষ্ট কৃষি এবং কৃষকের জ্ঞানকে গুরুত্ব দেয়ার।
তাই বারসিক যখন বৈচিত্র্য নিয়ে কথা বলে তখন এটি আসলে চলে আসে কৃষকের দৃষ্টিতে দেখা বৈচিত্র্যকে। আর কৃষি হচ্ছে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের টিকে থাকার, বেঁচে থাকার জ্ঞান এবং কৌশল। তাই গ্রামের মানুষের সাথে সর্ম্পক স্থাপনের একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে কৃষিকেন্দ্রিক কৃষকের চিন্তা দর্শনকে প্রাধান্য দিয়ে সামাজিক সম্পর্ক, পরিবেশ, সমাজনীতি, অর্থনীতি তথা সমাজ কাঠামোকে বোঝা।
বীজ হচ্ছে কৃষির প্রথম এবং প্রধানতম হাতিয়ার। বীজকে কেন্দ্র করেই কৃষির যতধরনের সমস্যার সূচনা; কৃষির ব্যবসায়িক এবং রাজনৈতিক যাত্রা। বীজ যখন কৃষকের হাত থেকে বাজারের হাতে চলে গেছে তখন বীজ এবং কৃষির সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়গুলো নষ্ট হয়ে যায়। একটি গ্রামের মধ্যে যে সামাজিক সংহতি আছে সেগুলো ভেঙে পড়ে। সংহতির সাথে সাথে মানুষে মানুষে যে ইউনিটি আর থাকে না। কেননা কৃষি ও কৃষকের সম্পর্ক বিনিময়ের সম্পর্ক যা বাজার থেকে আসে না। যদি আসে তবে সেটা পারস্পারিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক নয়, নৈর্ব্যত্তিকভাবে ক্রেতা-ভোক্তার সম্পর্ক। পারস্পারিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক তৈরি হয় পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মান প্রকাশের ভেতর দিয়ে।
এই নির্ভরশীলতার সম্পর্ক শুধু মানুষে মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই নির্ভরশীলতা প্রাকৃতিক উপদানের মধ্যে রয়েছে। রয়েছে পেশার বৈচিত্র্যতার মধ্যেও। যদি কৃষি ভালো না থাকে তাহলে মাছ থাকবে না। আর মাছ যদি না থাকে বাঁশ-বেত শিল্প থাকবে না। এই বাঁশ-বেঁত শিল্প যে সমস্ত উপকরণ বানায় সেগুলো বেশিরভাগই লাগে মাছ ধরা এবং কৃষি ক্ষেত্রে। কৃষির মতো মৎস্যও যদি বাণিজ্যিক হয়ে যায় তাহলে বাঁশ-বেঁত শিল্পও হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে কুমার। কারণ কৃষির সাথে মাটির যে সম্পর্ক; বীজের সাথে মাটির যে সম্পর্ক সেটি হারিয়ে গেলে মাটির গুনগত মান নষ্ট হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে কাজের ক্ষেত্র তৈরি না হওয়া। যেহেতু এখানে জনসংখ্যা বেশি সেহেতু এখানে কাজের চাহিদাও বেশি। আর কাজের সংকট তৈরি করতে হবে রাখতে হবে মুক্তবাজার অর্থনীতির ব্যবসায়িক স্বার্থে। প্রতিদিন কৃষি, মৎস্য, বাঁশ-বেঁত শিল্পের মতো অসংখ্য কাজের ক্ষেত্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে মানুষগুলো কী করবে বা তাদের কী ধরনের কাজ সরবরাহ করা হবে। কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে একটার সাথে আর একটার আন্তঃসম্পর্কের মধ্য দিয়ে। আর যখন এই আন্তঃসম্পর্ক থাকছে না তখন তৈরি হচ্ছে সমস্যা। আমরা তখন হয়ে যাচ্ছি ব্যবসায়ী। আর তখনই বাজার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ অর্ন্তভূক্ত থাকে প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। কিংবা এভাবে বলা যায় সকল জ্ঞানের উৎপত্তি এই প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে। কিন্তু যখন এই প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর না থেকে সবাই বাজারনির্ভর ব্যবসায়ী হয়ে যাচ্ছি তখন আর নতুন জ্ঞান উৎপাদন হচ্ছে না। আর এই জ্ঞান যখন একটা কমিউনিটি থেকে উৎপাদন হচ্ছে না তখন এই জায়গাটা দখল করছে বাইরে থেকে আগত মানুষ, প্রযুক্তি এবং কোম্পানি।
এর ফলে কৃষক, জেলে এবং বাঁশ-বেত শিল্পীর মধ্যকার যে আন্তঃসম্পর্ক সেটি না থাকলে কোনভাবেই কেউ টিকবে না। শুধু মাছ বাঁচিয়ে জেলেকে রক্ষা করা যাবে না; যদি না ভিন্ন ভিন্ন মাছ না থাকে তাহলে সেই ভিন্ন ভিন্ন মাছ ধরার জন্য ভিন্ন ভিন্ন উপকরণ থাকবে না। ভিন্ন ভিন্ন উপকরণ থাকবে না; যদি না কৃষকের বাঁশ-বেঁত এর জন্য আলাদা জায়গা না থাকে। এই আন্তঃসম্পর্ক ঘুরে ফিরে বারবার আসে শেষ হয় কৃষিতে। তাই সবার আগে এই দেশের নিজস্ব কৃষি ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হবে।
এই ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হলে এই প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যকার যে আন্তঃসম্পর্ক, আন্তঃনির্ভরশীলতা এবং আন্তঃবিনিময়কে বজায় রাখতে হবে। তাই কৃষিকে রক্ষা করতে হলে শুধু কৃষি বা কৃষক দিয়ে হবে না। কৃষি বা কৃষকের সাথে সাথে জেলেকে রক্ষা করতে হবে। জেলেকে দিয়ে জেলে রক্ষা হবে না যদি কোন মাছ ধরার জন্য কি ধরনের জিনিস দরকার- তা না থাকে। তাই এই ব্যবস্থার জন্য প্রতিটি জায়গাকে শক্তিশালী করতে হবে। একই সাথে এদের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক এবং আন্তঃনির্ভরশীলতাকে শক্তিশালী করতে হবে। তখনই বারসিক এর বিভিন্ন পেশাভিত্তিক সংগঠনগুলো সামনে চলে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষক সংগঠন, জেলে সংগঠন, বাঁশ-বেঁত সংগঠন, মাটিকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীর সংগঠনসহ অন্যান্য সংগঠন গড়ে উঠেছে।
বারসিক শুরু করেছিল শুধু কৃষি দিয়ে। কিন্তু বর্তমানে কৃষি কিন্তু শুধু কৃষি থাকেনি। বীজ কিন্তু শুধু বীজ থাকেনি। এটি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল যে কোন একটি গ্রামের সমগ্র বিষয়ই অর্ন্তভুক্ত হয়েছে। তাই বারসিক এর কাছে কৃষি কক্ষনোই শুধুমাত্র উৎপাদনের বিষয় না। কৃষি সামাজিক সম্প্রীতির বিষয়। সামাজিক বন্ধনের বিষয়। কৃষি হচ্ছে পরিবেশ এবং প্রতিবেশের বিষয়। কৃষি হচ্ছে প্রাণ বৈচিত্র্যের বিষয়।
তাই বারসিক কৃষিকে কেন্দ্র করে একটি গ্রামের সকল বিষয় নিয়ে কাজ করে থাকে। কৃষি কেন্দ্রিক অন্যান্য কার্যক্রমগুলো শুধুমাত্র উৎপাদনকে নয়; মানুষে মানুষে আন্তঃসম্পর্ক, আন্তঃনির্ভরশীলতাকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

বীজ বিদ্যাপীঠের অনেকগুলো ‘না’

শিক্ষা জীবনে শিখে ছিলাম ‘রিজিড’ (rigid) হওয়া যাবে না। উদার হতে হবে, কঠোর হওয়া যাবে না। কিন্তু বীজ বিদ্যাপীঠ এসে শিখলাম কোন একটি দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটু নয় অনেক বেশি রিজিড হতে হয়। বীজ বীদ্যাপীঠে অনেকগুলো ‘না’ শিখবেন।  প্রথম ‘না’ তো আগেই বলেছি ‘এখানে কোক এবং পেপসি খাওয়া নিষেধ’। এগুলো নিষেধ হওয়ার কারণ যতটা না এর স্বাস্থ্যগত দিক তার চেয়ে বেশি। এই কোম্পানি দুটির সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র। পাশপাশি, ইন্ডিয়ায় এই কোম্পানির বিরুদ্ধে ‘নবধান্যিয়া’ সফল আন্দোলনের ইতিহাস। উত্তরাখণ্ডে একটি এলাকায় কোকা কোলা কোম্পানি একটি ফ্যাক্টরি তৈরি করতে গেলে তার আশু প্রভাব পরে এলাকার পানি সম্পদ এবং পরিবেশ এর উপর। সেই সময় নবধান্যিয়া এলাকার জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে সেই ফ্যাক্টরি বন্ধ করতে সক্ষম হয়। এখন যাদের বিরুদ্ধে আন্দলোন করা তাদের পণ্য ভোগ করা বা করতে দেয়া স্ববিরোদ্ধিতা। পাশাপাশি এখানে আসা প্রতিটি শিক্ষার্থী এই ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে। তাদের মধ্যে একটি ইতিবাচক প্রভাব পরে এই রিজিড বা কঠোর হওয়ার বদৌলতে।
দ্বিতীয় না হচ্ছে এখানে থালা-বাসন ধোয়ার জন্য কোন ডিটারজেন্ট বা কোন ক্যামিকেল ব্যবহার করা হয় না। এখানে রিঠা ফলকে পানিতে সিদ্ধ করে এক ধরনের তরল তৈরি করা হয়। সেটিই ব্যবহার করা হয়।
প্রথমেই উল্লেখ করেছি, এই খামারের একটি বড় অংশ আম বাগান। সেই আমবাগানের বেশিরভাগ অংশটাই লিজ দেওয়া। রাতে সেখানে প্রায় পটকার আওয়াজ পাওয়া যেত। হঠাৎ হঠাৎ চমকে যেতাম। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আম বাগানে এই সময় প্রচুর পাখি আসে আর পাখি তাড়ানোর জন্য পটকা (বাজি) ফুটানো হয়। কারণ এই আম বাগানে কোন ধরণের কীটনাশক ব্যবহার নিষেধ। এমন শর্তেই বাগানটাকে লিজ দেয়া হয়েছে। এই কারণে বাজারের থেকে অনেক কম মুল্যেই লিজ দেয়া হয়েছে। আর  আম বাগানের যে অংশটুকু লিজ দেয়া হয়নি সেখানে পাখি তাড়ানোই হয় না। গাছে আমে ভরপুর গাছে বক পাখির আস্তানা। পাখি আম খাচ্ছে তবুও তাড়ানোর জন্য কোন ধরণের আগ্রহই নেই। এই পাখি গুলো আমে পোকা থেকে রক্ষা করছে।
প্লাস্টিক একদমই না। পুরা খামারে প্লাস্টিক না ব্যবহারের এক ধরণের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যতক্ষণ পারা যায় প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় না। পুরা খামারে কয়েকটি পাপোস এবং টয়লেট পরিষ্কার করার ব্রাশ ছাড়া আর কিছুই প্লাস্টিকের চোখে পরেনি। এমনকি ডাস্টবিনের জন্যও প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় না।
এই বিশাল খামার চাষা করার জন্য ট্র্যাক্টর নয়। গরু টানা লাঙ্গল ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহারের চেয়ে শ্রম, জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা ব্যবহারের প্রতি বেশি গুরুত্ব ব্যবহার করা হয়।
এসি কিংবা ফ্রিজ নেই। পানি ঠান্ডা রাখার জন্য মাটির পাত্র। ফ্রিজ এর চেয়ে টাটকা খাবার এবং সবজিকে উৎসাহ প্রদান করা হয়। অন্যান্য খাবার সংরক্ষণের জন্য ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
রাসায়নিক সার, কীটনাশক, দেশীয় জাতের বীজ ছাড়া অন্য কোন বীজ ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। রাসয়নিক সারের পরিবর্তে কেঁচো সার, পিট কম্পোস্ট, ম্যানিওর ব্যবহার করা হয়। রাসায়নিক কীটনাশক এর পরিবর্তে পাখি এবং জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা হয়।
বীজ ঘরের বীজকে ইঁদুর থেকে রক্ষা করার জন্য বিড়াল পোষা হয়। পাশাপাশি বীজ বিদ্যাপীঠের এলাকায় ধূমপান এবং মদ্যপান একদমই নিষেধ।
এই ধরণের কিছু ‘না’ এর মাধ্যমে বীজ বিদ্যাপীঠ এক অনন্য পরিচয় লাভ করেছে। এই সমস্ত ছোট ছোট বিষয়ের সাথে আপোষ না করার ফলে এটি সারা ভারতে এমনকি সারাবিশ্বে অরগানিক খামারের এক আদর্শ উদাহরণ। সারা ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য শিক্ষার্থী এই বীজ বিদ্যাপীঠ এ ইন্টার্নশিপ, স্বেচ্ছাসেবক এবং বিভিন্ন কোর্স করতে আসে।

বীজ বিদ্যাপীঠ এর শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপদ্ধতি

‘নবধান্যিয়া’ শব্দের অর্থ হচ্ছে নয়টি শস্য বীজ। নব=৯ আর ধান্যিয়া= শস্যবীজ। এটি একটি জীব বৈচিত্র্য খামার (Bio-Diversity  Firm)। একই সাথে এটি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের-নাম ‘বীজ বিদ্যাপীঠ’ ইংরেজিতে বলা হয় ‘Earth University’। এই প্রতিষ্ঠানটির দাবি অনুযায়ী এটি একটি অর্গানিক বা জৈব কৃষি শিক্ষার আদর্শ স্থান।
বীজ বিদ্যাপীঠ এর শিক্ষার্থী মূলত চার ধরনের।
ক) ইন্টার্ন- যাদেরকে কমপক্ষে ১ মাস বিদ্যাপীঠে অবস্থান করতে হবে।
খ) বিভিন্ন কোর্সের শিক্ষার্থী
গ) স্বেচ্ছাসেবক
ঘ) দর্শনার্থী- যারা এক মাসের কম বিদ্যাপীঠে অবস্থান করে।
এই চার ধরনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম দুই ধরনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রুটিন রয়েছে। শিক্ষার ধরণ সম্পূর্ণ হাতে কলমে। শিক্ষার্থীদের আবাসিক অবস্থান বাধ্যতামূলক। দিন শুরু হয় সকাল ৬ টায়। ৬টায় থেকে ৭টা পর্যন্ত মেডিটেশন। ৭টায় ভেষজ চা। এরপর সকাল ৮টা পর্যন্ত বিরতি। এর মধ্যেই অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ করতে হবে। কেননা ৮ থেকেই মূলত শিক্ষার্থীদের ব্যস্ততা শুরু হয়। সকাল ৮ থেকে ৮ টা ৩০ পর্যন্ত সকালের নাস্তা। ৮টা ৪৫ থেকে মর্নিং গ্যাদারিং(সকালের স্মাবেশ)। এই অধিবেশনে অনেক গুলো কাজ করা হয়। প্রথমত, একটি উক্তি এবং সেটির অন্তর্নিহিত বক্তব্য দিয়ে শুরু হয়। তারপর একটি খেলা কিংবা কাজ; যেটি সবাই মিলে যেন করতে পারে। এই অধিবেশনের সবশেষে দিনের সবার একটি প্রার্থনা বা আশা প্রকাশ করা হয়। যেমনঃ আজ যেন বৃষ্টি হয়, গরম যেন কম পড়ে, প্রভৃতি।
সকাল ৯ টায় শুরু হয় ‘শ্রমদান’। এই শব্দটি মহাত্মা গান্ধীর জীবন ও দর্শন থেকে নেয়া। ‘শ্রমদান’ শব্দের অর্থ হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা। বীজ বিদ্যাপীঠের কোন একটি অংশকে সবাই মিলে পরিষ্কার করার নামই হচ্ছে ‘শ্রমদান’। এটি অবশ্যপালনীয় একটি কাজ। ১০টা থেকে ১২ টা মূলত হাতে-কলমে বীজ বিদ্যপীঠের খামারে কাজ করা। মাঝখানে ১১টায় রয়েছে চা অথবা শরবতের বিরতি। এই ২ ঘণ্টা কাজ করতে হবে খামারে কীভাবে জৈব উপায়ে চাষাবাদ করা যায় সেই জিনিসগুলো। কোন দিন, জমি প্রস্তুত, কোন দিন বীজ সংগ্রহ আবার কোন দিন চারা বা বীজ বপন। এটা শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে করতে হয় না। খামারের কর্মচারীরা যেদিন যে কাজ করে সেই কাজে সহযোগিতা এবং শিখে নেওয়াই এই অধিবেশনের মূল লক্ষ্য। তবে প্রতিদিন যে খামারের কাজে সহযোগিতা করতে হয় এমনটা নয়। নিজে নিজে শিক্ষার্থীদের কৃষি কাজ করার জন্য রয়েছে আলাদা জায়গা; যার নাম “জ্ঞান গার্ডেন”।
‘জ্ঞান গার্ডেন’ একটি নাশপাতি গাছকে ঘিরে গোলাকার একটি জায়গার নাম জ্ঞান গার্ডেন। এখানে হাতে-কলমে এবং পঠিত বিষয় শিখে প্রয়োগ করার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করা হয় বলে এই বাগানের নাম জ্ঞান গার্ডেন। এই বাগানের কোন কাজই খামারের কর্মচারী করেন না। এখানের সব কাজই করতে হয় এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের। মাঠ প্রস্তুত থেকে শুরু করে বীজ বপন এমনকি ফসল উত্তোলন করে বিদ্যপীঠে আগত বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের। একটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা হয়তো বীজ বপন করে গেলো আর এক ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এসে হয়তো সেই ফসল উত্তোলন করছে। শিক্ষার্থীরা এই বিদ্যাপীঠ ত্যাগ করলেও ফোনে কিংবা বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে খবর রাখে তাদের জ্ঞান গার্ডেনের ফসলের।
১২ টা থেকে ১টা পর্যন্ত গোসল এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ করার সময়। ১টা থেকে ২ টা দুপুরের খাবার। ২টা থেকে ৩টা বিরতি। ৩টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত ক্লাস বা তাত্ত্বিক আলোচনা। এই সময়ে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা হয়।
৫টায় চা বিরতি এবং ৫ টা থেকে ৮টা পর্যন্ত ফ্রি সময়। এই সময় খেলাধুলা এবং অন্যান্য বিনোদন এর জন্য। ৮টায় রাতের খাবার। ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত আড্ডা, আলোচনা, পড়াশুনা। তবে রাত ১০ টা থেকে পরদিন সকাল ৬টা হচ্ছে নিরব সময়। এই সময় রুমে বসে পড়াশুনা কিংবা অন্যান্য কাজ করা যাবে। তবে অন্য কারো অসুবিধা হয় এমন কোন কাজ করা যাবে না।
এই রুটিন পড়ে মনে হতে পারে এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ-পদ্ধতি কোথায়? বীজ বিদ্যাপীঠ ক্লাস রুমভিত্তিক শিক্ষা দানের চেয়ে হাতে-কলমে এবং উন্মুক্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে শিখুক। তাহলে তাদের মধ্যে এই জানার প্রভাবটা গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী হবে। আপনি হয়তো দুপুরের খাবার খেতে খেতে কারো সাথে জৈব কৃষির বাজারজাতকরণের বিষয়গুলো নিয়ে কথা বললেন। কিংবা বিকালের চা খেতে খেতে জেনে নিলেন বীজ বিদ্যাপীঠের ইতিহাস এবং দর্শন।
সপ্তাহের কোন দিন কোন বিষয়গুলো নিয়ে গুরুত্ব দেয়া হবে সেটিও নির্ধারণ করা আছে এখানে। যেমন ভারতে সপ্তাহ শুরু হয় সোমবারে। আর সোমাবারে শেখার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হবে চিকিৎসা (ভেষজ), মঙ্গলবার বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, বুধবারে দক্ষতা বিনিময়(আপনি হয়তো কোন গান, কিংবা ভালো হাতের কাজ পারেন সেটি সবার সাথে শেয়ার করবেন), বৃহস্পতিবার ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী, শুক্রবারে সবাই মিলে রান্না করা, শনিবার মুলত শিক্ষার্থীদের নিজের জন্য (জামাকাপড় পরিষ্কার, নিজের ঘর গোছানো, প্রভৃতি)। আর সবচেয়ে মজার দিন হচ্ছে রবিবার-এদিন শুধুই বিনোদন। ওখনাকার ভাষায় “সানডে-ফানডে”।
এখানকার মূল বিশয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য হয়তো নির্ধারিত একজন আলোচক থাকে; তাছাড়া ওখানের সবার কাছ থেকে আপনি শিখতে পারেন। যিনি জমি চাষ করেন তার কাছ থেকে শিখে নেন কীভাবে জমি প্রস্তুত করতে হয়। যিনি বীজ সংরক্ষণকারী তার কাছ থেকে শিখে নেন বীজ সংরক্ষণ এর বিষয় গুলো। পাশাপাশি এখানে রয়েছে পাঠাগার-আপনি ইচ্ছে হলে সেখানে বসে পড়ে নেন যে বিষয়টি সম্পর্কে আপনি বিস্তারিত জানতে চান।
শেখাটা এখানে তাই পড়া এবং শুনা একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি চর্চা, প্রতিদিনকার নিত্যনৈমিত্তিক কাজের মধ্য দিয়ে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করার বিষয়। আপনি হয়তো কিছু খাচ্ছেন-খাওয়ার মধ্য দিয়ে জেনে নিন কি খাচ্ছেন? কেন খাচ্ছেন? কি খাওয়া উচিত? হয়তো চিন্তা করছেন-এমন কোন চিন্তা করুন যেটি একজন কৃষক করে। পানি খাচ্ছেন খান যেভাবে খাওয়া উচিত-মাটির পাত্রে; বোতলজাত নয়।